অশীতিপর বৃদ্ধ ইদ্রিস শেখ কেন জামিন পাবেন না?

1 month ago 6

ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফারাবী অন্তবর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন। বিচারিক আদালতের দেওয়া দণ্ডাদেশের রায়ের বিরুদ্ধে ২০২১ সালে হাইকোর্টে আপিল করে ফারাবী। আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে জামিন দিয়েছে। শুধু জানতে ইচ্ছা করছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন আসামি কীভাবে জামিন পায়? আর অশীতিপর বৃদ্ধ একজন ইদ্রিস শেখ কেন জামিন পাবেন না?

ভিডিওতে দেখলাম বৃদ্ধ ব্যক্তিকে একজন পুলিশ সদস্য হাত ধরে সিঁড়ির কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। সেই বৃদ্ধের ডান হাতে একখানা লাঠি। লাঠির ওপর ভর দিয়ে তিনি সিঁড়ির দিকে যাচ্ছেন। কিন্তু তিনি কোনোভাবেই সেই সিঁড়ি বেয়ে তিন তলা থেকে দোতলায় নামতে পারছিলেন না। দুজন পুলিশ কনস্টেবল অশীতিপর এই বৃদ্ধের দুই বাহু ধরে ছিলেন। ইদ্রিস শেখ হাঁপাচ্ছিলেন। একশ বছরের বেশি বয়সী ইদ্রিস শেখকে যখন নিচতলার হাজতখানার সামনে আনা হয়, তখন তাঁর ছেলে বাবুল শেখ বাবার দুরবস্থা দেখে কেঁদে ফেলেন। বাবুল শেখের বয়সও ৭০ এর বেশি।

সেই কবেকার একটি মামলার আসামি ইদ্রিস শেখ। ইদ্রিস শেখ হাজতখানার ভেতরে ঢুকে যান। তখন হাজতখানার সামনেই অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁর ছেলে বাবুল শেখ। বাকি তিন ছেলে মারা গেছেন। ইদ্রিস শেখের বয়সী আর কেউ এলাকায় বেঁচে নেই। বহু বছর আগে একটি খুনের মামলার আসামি হন তিনি এবং সেই মামলার ঘানি টেনে চলেছেন এখনো।

আসামি অশীতিপর বৃদ্ধ, হাঁটতে পারেন না, সিঁড়ি বাইতে পারেন না, মাটিতে বসতে পারেন না, প্রিজন ভ্যানে উঠতে পারেন না এবং ভ্যান থেকে আকাশ দেখতেও পারেন না। অথচ তাকে হয়তো আরো বহুবছর বিচারের জন্য আদালতে আসতে হবে এবং আবারো এই ধরনের দুর্দশার মুখোমুখি হতে হবে। যতোই দুর্দশা হোক, আদতে ওনার জামিন হবে কিনা আমরা জানিনা। হলেও কবে হবে তাও বলতে পারি না। অথচ এই দেশেই পয়সা ও ক্ষমতার জোরে জামিনে বেরিয়েই খুনোখুনিতে জড়িত হয়েছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।

বৃদ্ধ বাবার কষ্ট দেখে ছেলে বাবুল শেখ কাঁদতে থাকেন। ইদ্রিস শেখ যখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে, তখন অন্য বন্দিরা তাঁকে উঁচু করে ধরেন। ভ্যানের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ইদ্রিস শেখ কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই তিনি ছেলেকে বলছিলেন, আমার জামিনের ব্যবস্থা করো। বাবুল শেখও বাবাকে দেখে কাঁদছিলেন। এর কিছুক্ষণ পর ইদ্রিস শেখকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওনা হয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবুল শেখ হতবিহ্বল চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন।

ইদ্রিস শেখের দুর্দশার এই খবর ছাপা হয়েছে প্রথম আলো পত্রিকায়। খবরটি পড়ে খুব মায়া লাগলো। এই প্রথম একজন অভিযুক্ত আসামির জন্য মায়া লাগলো। আসামি অশীতিপর বৃদ্ধ, হাঁটতে পারেন না, সিঁড়ি বাইতে পারেন না, মাটিতে বসতে পারেন না, প্রিজন ভ্যানে উঠতে পারেন না এবং ভ্যান থেকে আকাশ দেখতেও পারেন না। অথচ তাকে হয়তো আরো বহুবছর বিচারের জন্য আদালতে আসতে হবে এবং আবারো এই ধরনের দুর্দশার মুখোমুখি হতে হবে। যতোই দুর্দশা হোক, আদতে ওনার জামিন হবে কিনা আমরা জানিনা। হলেও কবে হবে তাও বলতে পারি না। অথচ এই দেশেই পয়সা ও ক্ষমতার জোরে জামিনে বেরিয়েই খুনোখুনিতে জড়িত হয়েছে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে রাজধানীর ২৭ দাগি সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে এসেছে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, দাগি আসামিরা বের হয়ে এসে আবার সুসংগঠিত হচ্ছে এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীরা কেউ বসে নেই। সবাই আধিপত্য বিস্তার করতে নতুন ও পুরোনো সহযোগীদের দলে ভিড়িয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের মেতে উঠেছে।

বড় অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে আবারও আগের মতো তৎপরতা শুরু করেছে। বর্তমান পরিস্থিতির সাথে দূরত্ব কমানোর জন্য ব্যবহার করছে কিশোর গ্যাং সদস্যদের। এরা তাদের পুরোনো পয়েন্টে ফিরে গিয়ে চাঁদাবাজি, হামলা, ভাঙচুর, ছিনতাই, রাহাজানিতে জড়িত হয়ে পড়ছে। অথচ ইদ্রিস শেখের মতো একশ বছরের বেশি বয়সী বৃদ্ধ অভিযুক্ত আসামি কাঁপতে কাঁপতে চলে গেলেন কাশিমপুর কারাগারে। আমি নিজে যেহেতু অন্যের সাহায্য ছাড়া হাঁটতে পারি না, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে পারি না, মাটিতে বসতে পারি না, তাই আমি বুঝতে পারছি বৃদ্ধ ইদ্রিস শেখের কতখানি কষ্ট হচ্ছে। আমরা আশা করবো আদালত শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুত ইদ্রিস শেখকে জামিন দেবেন। আশা করা যায়, আর যাই হোক, জামিন পেয়ে উনি অন্তত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মতো হানাহানিতে জড়িয়ে পড়বেন না।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অনেক অপরাধী জেল থেকে পালিয়েছে, জামিন পেয়েছে অনেক দাগি সন্ত্রাসী। একটি সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক অপরাধীরা জামিন পেতে পারে। কিন্তু দাগি আসামিরা কেন জামিন পাবে, এর কোন ব্যাখ্যা নেই। দাগি অপরাধীদের স্বভাবে কোনো পরিবর্তন না আসায় জামিনে বেরিয়ে এসে তারা জড়াতে থাকে একের পর এক অপরাধমূলক কাজে।

বিশেষ করে নিজেদের অপরাধ সাম্রাজ্য ধরে রাখতে জড়াচ্ছে নতুন নতুন অপরাধে। চাঁদাবাজি, ব্যবসার ভাগ ও এলাকা দখলে নিতে নিজেদের নব্য বাহিনী দিয়ে খুনোখুনিতেও জড়াচ্ছে তারা। এরাই রাজনৈতিক কোন্দলে জড়িত হয়ে হত্যা, চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছে। যে কারণে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়েছে। পুরোনো ও নতুন অপরাধী চক্র সমন্বিতভাবে এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এদের ঠেকাতে বেগ পেতে হচ্ছে। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার পাশাপাশি জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক।

অপরাধীদের থাকে বিশটা হাত, সক্রিয় সাপোর্ট, টাকা, অস্ত্র। এমনকি জেলখানার ভেতরে থেকেও এরা সাম্রাজ্য চালিয়ে যেতে পারে। টাকা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে এরা সবসময় স্বাধীন। এরা বন্দী হয়েও রাজ্যপাট চালাতে পারে। শুধু অপরাধ ঘটানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এই লোকগুলি। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডসহ পেশাদার সন্ত্রাসীরা।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গণমাধ্যমে বলেছেন,‘শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে বের হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে যে নজরদারির কথা বলা হয়েছিল সেটির কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পুলিশের পক্ষে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা কতটা সম্ভব সেটিও ভেবে দেখা উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে পুলিশ এ ধরনের নজরদারি পারবে না। এ সুযোগ নিয়েই ভয়ার্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে সন্ত্রাসীরা।’

ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের ধরার জন্য পুলিশ বাহিনীকে অনেক শ্রম দিতে হয়। এইসব অভিযান পরিচালনা করা সহজ কিছু নয়। এত ঘাম ঝরিয়ে যে অপরাধীদের আটক করা হয়, তারাই আবার জামিনে বেরিয়ে আসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে চিন্তা দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন মামলার আসামিরা কোনো পক্ষকে ‘ম্যানেজ’ করে জামিন পাওয়ার পথ তৈরি করছে। পাশাপাশি এরা ক্ষমতা খাটিয়ে অপরাধ অনুযায়ী মামলা না নিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা করানোর চেষ্টা করছে, যা খুব বিপজ্জনক।

ছিনতাই-ডাকাতির মামলার আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে আবার একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। আদালত অপরাধের মাত্রা বা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যে কাউকে জামিন দিতে পারেন। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মামলার চার্জশিটটা এমনভাবে দেয়া হয় যে অপরাধীর অপরাধ দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকসময় যথাযথ সাক্ষীর অভাবেও মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে।

আমরা সেদিন জানতে পারলাম যে ছিনতাই-রাহাজানি করার জন্য বিভিন্ন অস্ত্র যেমন ভাড়ায় পাওয়া যায়, তেমনি জামিন পাওয়ানোর জন্যও লোন দেয়া হয়। কাজেই ধরেই নেয়া যায় জামিনের নেপথ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘জামিন বাণিজ্য’ থাকে। গত এক বছরে বাংলাদেশে দাগি আসামিদের জামিন পাওয়ার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না পাওয়া গেলেও, জানা গেছে গত আট মাসে (আগস্ট ২০২৪ থেকে এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত) জঙ্গিবাদের মামলায় অভিযুক্ত প্রায় ৩৪৬ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। যাদের মধ্যে সন্দেহভাজন, বিচারাধীন এবং এমনকি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও রয়েছে। এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায়, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় প্রায় ২৫০ জন আসামি জামিন পেয়েছেন। এই সংখ্যাগুলো নির্দিষ্ট ধরনের মামলার সাথে সম্পর্কিত এবং সামগ্রিক দাগি আসামিদের জামিনের সংখ্যার একটি আংশিক চিত্র।

দাগি আসামি ছাড়াও চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের আসামিরা অধিকহারে জামিন পেলে আইনলৃংখলা বাহিনীর জন্য তা খুব নেগেটিভ ফল বয়ে আনে। এরা মাঠে নেমে পড়ে এবং অপরাধ জগত সম্পর্কে জুনিয়রদের বিভিন্নধরনের ট্রেনিং দেয়, যা সমাজ, আইনশৃঙ্খলা এবং বিচার ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। দাগি আসামি, বিশেষ করে হত্যা, ধর্ষণ বা মাদক সংক্রান্ত মামলার আসামি, জামিনে মুক্ত হলে ভুক্তভোগী পরিবারকে হুমকি দেয়। মামলা তুলে নিতে বলে। এতে চরম নিরাপত্তাহীন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

জামিনে মুক্ত আসামি মামলার সাক্ষীদের প্রভাবিত করে বা প্রমাণ নষ্ট করতে চায়। যদিও আদালত বলেন যে জামিনে মুক্ত আসামিরা তদন্তে প্রভাব ফেলতে পারে না, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারা সাক্ষী ও ভিকটিমকে ভয় দেখায়। এছাড়া তারা মামলা তুলে নেয়ার জন্যও চাপ দেয়, যা বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। অনেকসময় দেখা যায়, আসামি জামিন পেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যা বিচার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে।
সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো দাগি আসামিদের বারবার জামিন প্রদান, বিশেষ করে প্রতারণা বা জালিয়াতির মাধ্যমে, বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে দুর্বল করে তোলে। এইদেশে আসামিরা এতোটই শক্তিশালী যে এজাহার পরিবর্তন করে জামিন নেয়ার নজিরও আছে।

দাগি আসামির জামিন হলে ভুক্তভোগীদের নিরাপত্তাহীনতা, বিচার প্রক্রিয়ায় বাধা, আসামি পালিয়ে যাওয়া, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। তাই আমরা আশা করবো জামিন প্রক্রিয়া আরো কঠোর হোক, বিশেষ করে দাগি, শীর্ষ খুন ও ধর্ষণ মামলার আসামিদের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক চাপে জামিন দেয়া মানে সাধারণ মানুষের অধিকার খর্ব করা।

৫ আগস্ট, ২০২৫

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম

Read Entire Article