জনতা ব্যাংকের মাধ্যমে আলোচিত অ্যাননটেক্স গ্রুপকে দেওয়া ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারিতে এবার নাম এসেছে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান, অর্থনীতিবিদ ও আওয়ামী লীগপন্থি এক সময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তি ড. আবুল বারকাতের।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) গত ২২ মে এ ঋণ জালিয়াতি মামলায় তাকে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানসহ ২৩ জনকে আসামি করে মামলা করে। এ মামলায় বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে আবুল বারকাতকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আবুল বারকাত চেয়ারম্যান থাকাকালীন অ্যাননটেক্সকে বিতরণ করা ২৯৭ কোটি টাকার ঋণ এখন শুধুই জনতা ব্যাংকের জন্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির জন্য এক দুঃসহ দায়। মামলার বিচারে তার ভূমিকাসহ বাকিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা না গেলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়।
কখন এবং কীভাবে বিতরণ হয় এই ঋণ?
দুদকের মামলার এজাহার অনুযায়ী, অ্যাননটেক্স গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান মেসার্স সুপ্রভ স্পিনিং লিমিটেড ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময় জনতা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। তবে মূলত বড় অঙ্কের বিতরণ ঘটে ২০১৩-১৪ সময়কালে, অর্থাৎ যখন আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি প্রথম দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে ছিলেন।
দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এসময়ের মধ্যেই জমির অস্বাভাবিক মূল্যায়নের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ হয়। তিন কোটি টাকার জমিকে ১৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায় অতিমূল্যায়ন করে ব্যাংকের মাধ্যমে প্রায় ২৯৭ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়, যা এখন আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত।
আবুল বারকাতের সময়েই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ:
অ্যাননটেক্স গ্রুপের অনুকূলে অনুমোদিত এ ঋণের বড় অংশ, বিশেষত ১৮০ কোটি টাকার একটি প্যাকেজ সুপ্রভ স্পিনিংয়ের নামে বিতরণ হয় ২০১৩ ও ২০১৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তদন্তে দেখা যায়, এ ঋণের একটি বড় অংশ (৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা) অ্যাননটেক্সের গ্রুপভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যা সরাসরি অর্থ আত্মসাতের শামিল বলে মনে করছে দুদক।
আবুল বারকাতের বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?
দুদকের মামলায় উল্লেখ আছে—আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির নেতৃত্বে থাকায় পুরো প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতেন। মামলার ভাষায়, ‘ঋণ পেতে ও আত্মসাতে তিনি ‘সহায়তা’ করেছেন।’
তিনি ছাড়াও ব্যাংকের সাবেক পরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ, মো. ইমদাদুল হক, নাগিবুল ইসলাম দীপু, ড. আর এম দেবনাথ, সঙ্গীতা আহমেদ, মো. আবু নাসের, নিতাই চন্দ্র নাথসহ এসময়ে ব্যাংকের বোর্ডে থাকা আরও বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধেও অনুরূপ অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঋণের বর্তমান অবস্থা কী?
এই ঋণের একাংশ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংক উভয়ের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এ ঋণ থেকে ফেরত আসা অর্থ প্রায় নেই বললেই চলে। অ্যাননটেক্সের গ্রুপভুক্ত কোম্পানিগুলোর বেশিরভাগই এখন দেউলিয়া অবস্থায় আছে, আর সুপ্রভ স্পিনিং কার্যত অনুপস্থিত। এ টাকার একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলেও আলামত পেয়েছে দুদক।
পূর্বের তদন্তে কেন অভিযোগ আসেনি?
দুদক ২০২২ সালে অ্যাননটেক্স কেলেঙ্কারির প্রাথমিক তদন্ত করলেও তখনকার প্রতিবেদনে আবুল বারকাত বা আতিউর রহমানের নাম আসেনি। তবে এবার তদন্তে নথিপত্র বিশ্লেষণ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে বলে জানায় সংস্থাটি।
রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থনৈতিক অনৈতিকতা
ড. আবুল বারকাত বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত হলেও তার নেতৃত্বে জনতা ব্যাংকে বিতরণ করা এ ঋণ এখন কেলেঙ্কারির বড় উদাহরণ। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকাকালীন তার নেতৃত্বে নেওয়া অনেক সিদ্ধান্তই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। অ্যাননটেক্সের মতো প্রতিষ্ঠানকে এত বড় অঙ্কে অর্থায়ন করা এবং কোনো কার্যকর মূল্যায়ন ছাড়া তা অনুমোদন দেওয়া প্রমাণ করে—তিনি ‘ব্যাংকের স্বার্থ নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য ও প্রভাবকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এবং খাত বিশ্লেষক এম হেলাল আহমেদ জনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আবুল বারকাত চেয়ারম্যান থাকাকালীন ননটেক্সেকে বিতরণ করা ২৯৭ কোটি টাকার এ ঋণ এখন শুধুই জনতা ব্যাংকের জন্য নয়, বরং সমগ্র অর্থনীতির জন্য এক দুঃসহ দায়। এ দায় তিনি এড়াতে পারেন না। মামলার বিচারে তার ভূমিকাসহ অন্যদের যথাযথ বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।’
ইএআর/এমকেআর/জিকেএস