২০২৪-২৫ অর্থবছরের বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরিকল্পনা জমা দিতে বলেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। শিগগির আইএমএফকে সেই পরিকল্পনা জানাতে চায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজস্ব আদায়ে শনির দশা কাটছে না। গত জুলাই ও আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাব কাটেনি অর্থনীতিতে।
এনবিআরের সর্বশেষ হিসাবে দেখা গেছে, চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে সার্বিকভাবে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা।
অর্থবছরের শুরুর পর জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর। লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার পাশাপাশি যোগ হয়েছে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।
গত জুলাই খেকে অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ১১৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। যার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ লাখ ১ হাজার ২৮১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এ সময়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ০৩ শতাংশ।
দাতা সংস্থা আইএমএফ সম্প্রতি এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরিকল্পনা জমা দিতে বলেছে সংস্থাটি।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা চলতি মাসের মধ্যেই পেতে চায় আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। এ পরিকল্পনা আইএমএফের ওয়াশিংটনের পর্ষদে উপস্থাপন করা হবে।
- আরও পড়ুন
৪ মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৩০ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা
৫ মাসে রপ্তানি আয় বাড়লেও পোশাকশিল্পের প্রবৃদ্ধির হার তুলনামূলক কম
গত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট এবং কাস্টমস উইংয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, নতুন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে হলে আগের তুলনায় প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে। কীভাবে এ অতিরিক্ত অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তার পরিকল্পনা দিতে বলেছে আইএমএফ। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে একাধিক খাতে আয়কর ছাড় দিয়েছে এনবিআর।
সূত্র জানায়, আয়কর শাখা থেকে নতুন করে চলতি অর্থবছরে কোনো কর রেয়াত বাদ দেওয়া বা করহার বাড়ানো কঠিন। কেননা বছরের মাঝামাঝি এসব পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব নয়। আবার আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বাড়ালে তার প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে সরাসরি পড়তে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। এসব বিষয় বিবেচনা করে কর ও শুল্ক খাতে সুবিধা কমানোর চিন্তা বাদ দিয়ে কীভাবে রাজস্ব আদায় বাড়ানো যায় তার চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে।
একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ভ্যাট শাখা কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এছাড়া বকেয়া কর, শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ে আরও তৎপরতা বাড়াতে পারে এনবিআর।
এক কর্মকর্তা জানান, কোন খাতের কর রেয়াত কমানো সম্ভব তা নিয়ে কাজ চলছে। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আলাপ-আলোচনা চলছে। বিষয়টি চূড়ান্ত করে আইএমএফকে জানানো হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন খাতে করছাড় কমানো হবে বলে জানিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় ওয়ালটন আয়োজিত শিল্পমেলা ‘এটিএস এক্সপো-২০২৪’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের চাপে কর অব্যাহতি ব্যাপক হারে কমানোর পরিকল্পনা নেওয়ার কথা জানান।
স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য করছাড় দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এগুলো দিয়েছি, নয়তো আপনারা এখানে আসতে পারতেন না। এগুলো দিয়েছি এফডিআই (বিদেশি বিনিয়োগ) টানতে; দেশের বিনিয়োগ বাড়াতে। এখন ট্যাক্স এক্সপেন্ডিচার (কর অব্যাহতি) কমাতে হবে ড্রাস্টিক্যালি। সম্প্রতি আইএমএফ প্রতিনিধিদের বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওনারা (আইএমএফ) বলেছেন আপনারা (এনবিআর) যে প্রতিবছর ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৩ লাখ কর ছাড় দেন, এগুলো কমাতে হবে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছে তিন লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা (আইবাস-এর হিসাব অনুযায়ী), যা জিডিপির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। আইএমএফ এর লক্ষ্য অনুযায়ী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের হার জিডিপির ০ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর কথা রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজস্ব আদায় কমতির দিকে। এতে এনবিআর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা রাজস্ব আদায়ে বিঘ্ন ঘটেছে। অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এর আগে রাজস্ব আদায় প্রত্যাশা অনুযায়ী নাও হতে পারে।
এর আগে গত ২ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে আর্থিক, মুদ্রা ও বিনিময় হার সংক্রান্ত সমন্বয় কাউন্সিলের এক সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বাস্তবসম্মত হবে না।
এসএম/ইএ/জেআইএম