গভীর রাতের নীরবতায় হঠাৎ যদি আপনার সামনে একটি কালো বিড়াল এসে দাঁড়ায়, তখন আপনার মনে কী আসে? অনেকেরই বুকের ভেতর কেমন এক অজানা আতঙ্ক দোলা দেয়। ছোটবেলা থেকে শুনে আসা নানা কুসংস্কার, গল্প কিংবা সমাজের ভয়ভীতি সব মিলিয়ে, কালো বিড়ালকে আমরা অনেক সময় অশুভর প্রতীক ভেবে নেই। অথচ বাস্তবে এই কালো রঙের লোমশ প্রাণীগুলোও আমাদের মতোই ভালোবাসা, যত্ন আর নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য।
বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে কালো বিড়াল নিয়ে অসংখ্য কাহিনি প্রচলিত। মধ্যযুগীয় ইউরোপে কালো বিড়ালকে জাদুকরীদের সহযোগী ভাবা হতো। তখন বিশ্বাস করা হতো, রাতের আঁধারে কালো বিড়াল নাকি অশুভ শক্তি বয়ে আনে। এমনকি গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেকেই বিশ্বাস করেন, রাস্তা পার হওয়ার সময় সামনে যদি কালো বিড়াল পড়ে, তবে সেই যাত্রা সফল হবে না। দক্ষিণ এশীয় সমাজেও এই ধরনের অন্ধবিশ্বাস কম নয়। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আবার অনেক সংস্কৃতিতে কালো বিড়ালকে সৌভাগ্যের প্রতীকও মনে করা হয়। স্কটল্যান্ডে বিশ্বাস করা হয়, কালো বিড়াল ঘরে এলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। জাপানেও কালো বিড়ালকে শুভ লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়।
অন্ধবিশ্বাসের বাইরে আসল সত্য হলো, কালো বিড়াল অন্য যে কোনো বিড়ালের মতোই একেবারে সাধারণ প্রাণী। তাদের বুদ্ধিমত্তা, আচরণ কিংবা স্বভাব অন্য রঙের বিড়ালের থেকে কোনো অংশে আলাদা নয়। তবে কুসংস্কারের কারণে কালো বিড়াল অনেক সময় অবহেলিত হয়। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে অন্য রঙের বিড়ালের তুলনায় এদের দত্তক নেওয়ার হার কম। ফলে অনেক কালো বিড়াল অবহেলা ও একাকিত্বের শিকার হয়।
এই অবহেলার বাস্তবতা থেকেই জন্ম নেয় জাতীয় কালো বিড়াল প্রশংসা দিবস (ন্যাশনাল ব্ল্যাক ক্যাট অ্যাপ্রিসিয়েশন ডে)। আমেরিকান নাগরিক ওয়েইন এইচ. মরিস ২০১১ সালে দিবসটি চালু করেন। মরিস এই দিনটি তার প্রয়াত বোন জুন এবং তার ২০ বছর বয়সী কালো বিড়াল সিনবাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠা করেন, যারা উভয়েই ২০১১ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমানে প্রতিবছর ১৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়। এর লক্ষ্য হলো কালো বিড়ালকে ঘিরে থাকা নেতিবাচক ধারণা ভাঙা এবং তাদের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দেওয়া।
এ দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা কুসংস্কার ও ভয়ের শেকল থেকে কালো বিড়ালকে মুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে অনেক কালো বিড়াল বছরের পর বছর অবহেলিত থাকে। দিবসটি মানুষকে সচেতন করে তোলে যে, তাদেরও ভালোবাসার অধিকার আছে। একইসঙ্গে এটি প্রাণীর প্রতি সহমর্মিতা জাগ্রত করে। কারণ রং, জাত কিংবা চেহারা নয়, সব প্রাণী সমান যত্ন পাওয়ার যোগ্য।
বর্তমান যুগে আমরা যখন বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গড়ার কথা বলি, তখন কালো বিড়ালকে ঘিরে অশুভ ধারণা পোষণ করা একেবারেই অযৌক্তিক। প্রাণীরা আমাদের পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিড়াল ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা ফসল ও খাদ্যশস্য রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে। একইসঙ্গে তারা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ালের সঙ্গে সময় কাটালে মানসিক চাপ কমে যায়।
তাই আমাদের উচিত কালো বিড়াল দেখলে ভয় পাওয়া বা ঘৃণা না করে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কালো বিড়াল দত্তক নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। বন্ধু বা পরিবারকে জানাতে হবে যে, কালো বিড়ালও অন্য রঙের বিড়ালের মতোই সাধারণ ও আদরের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দিয়েও মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে।
কালো বিড়ালকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে চলা অন্ধবিশ্বাস ভেঙে আজ সময় এসেছে নতুনভাবে ভাবার। তারা অশুভ নয়, বরং আমাদের জীবনের এক অংশ। অন্য প্রাণীদের মতোই আদরের সঙ্গী, পরিবারের সদস্য। সব প্রাণীর প্রতি সমান ভালোবাসা ও যত্নই হতে পারে সভ্য সমাজের আসল পরিচয়।
আরও পড়ুন
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল ডে ক্যালেন্ডার, ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল, ডেজ অব দ্য ইয়ার
কেএসকে/এমএস