বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হয়েছে। প্রতি বছরের মতো এবারও সুন্দরবনের গভীরে গিয়ে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করবেন।
মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়ে এ মধু আহরণ চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত।
সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় উপজেলা খুলনার কয়রা, দাকোপ ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা এখানে তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকায় বেশিরভাগ মানুষ সুন্দরবন নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরা ও মধু আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করা। তবে বর্তমানে বনদস্যুদের কারণে এই প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যাচ্ছে। ফলে স্থানীয় জেলে-বাওয়ালী ও মৌয়ালদের জীবিকা ও আর্থিক অবস্থায় প্রভাব পড়ছে।
মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) এবার মধু আহরণের জন্য মৌসুম শুরুর প্রথম দিন সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের নলীয়ান স্টেশন থেকে ৩টি, বানিয়াখালী স্টেশন থেকে ৯টি, কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন থেকে ১৮টি কোবাদক স্টেশন থেকে ৭টি, ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের অধিন্যস্ত স্টেশনগুলো থেকে থেকে ২১টি অনুমতিপত্র, নৌকার (পাস) দেওয়া হয়। এসব অনুমতিপত্র (পাস) নিয়ে মৌয়ালরা চলে যাবেন গহীন সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে মধু সংগ্রহ করতে।
তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে গত বছরের প্রথম দিনে খুলনা রেঞ্জে ১৬০টি ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশন থেকে ৩৬৪টি পাশ দেওয়া হয়েছিল। যা বর্তমান গত বছরের তুলনায় খুবই কম।
৪নং কয়রা গ্রামের মৌয়াল সোহরাব হোসেন বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর মধু আহরণের জন্য অনুমতি পেয়েছি। ৭ জনের বহর নিয়ে ১৫ দিনের জন্য বাজার-সদাই নিয়ে রওনা হচ্ছি। কিন্তু এ বছর ডাকাত দলের উৎপাত অনেক বেশি। তার ওপর আবার বৃষ্টি কম। বৃষ্টি না হলে ফুল ঝরে যায় মধু জমে না। বৃষ্টি না হওয়ায় চাকে কেমন মধু হবে সেটা নিয়ে চিন্তিত।
তবে সুন্দরবন সংলগ্ন স্থানীয় জেলে-বাওয়ালী ও মৌয়ালরা জানান, সুন্দরবনে ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকটি বনদস্যু দল থাকায় তারা মধু আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছেন। বনদস্যুদের হাতে নিরিহ জেলে-বাওয়ালীরা তাদের চাহিদা মতো মুক্তিপণ দিতে না পারায় হামলার শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কারণ তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে বনে ঢুকলে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যার কারণে তারা পূর্বের মতো সাচ্ছন্দ্যে মাছ-কাঁকড়া ও মধু আহরণে আগ্রহ হারাচ্ছে।
কয়েকজন মৌয়ালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ফুলের মধু আসে। এর ২০-২৫ দিন পর আসে গরান ফুলের মধু। শেষে আসে কেওড়া ও ছইলা ফুলের মধু। এই তিন প্রজাতির মধুর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও দামি হচ্ছে খলিশার মধু। মৌসুমের প্রথম ফুলের মধু যা দেখতে সাদা, গাঢ় ও অনেক বেশি মিষ্টি। তবে বৃষ্টি না হলে ফুল শুকিয়ে ঝরে যায়, মধু জমে না। এ বছর তেমন বৃষ্টি না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত মধু না পাওয়ার শঙ্কা আছে।
মৌয়াল রিয়াছাদ আলী সানা জানান, এলাকয় তেমন কোনো কাজকর্ম না থাকায় মহাজনদের কাছ থেকে ধারদেনা করে মধু কাটতে যাচ্ছি। মধু না পেলে চালানে মার খাবো ঋণের বোঝা নিয়ে টানতে হবে। আবার সুন্দরবনে কয়েকটি ডাকাত দল আছে তাদের কাছে ধরা পড়লে গুনতে হবে টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মৌয়াল জনান, সুন্দরবনে মৌসুম শুরুর আগেই এক শ্রেণির অসাধু লোক জেলের ছন্মবেশে মাছের (পাশ) নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে চুরি করে মধু সংগ্রহ করে। তবে একটি পরিপূর্ণ চাকে ৫-৭ কেজি মধু পাওয়া যায়, কিন্তু চোরা মধু আহরণকারীরা আগে চাক কাটার করণে যখন আমরা বৈধভাবে অনুমতি পত্র (পাস) পাই তখন সুন্দরবনে ঢুকে মৌচাকে ৫০০ থেকে ৭০০ গ্রামের বেশি মধু পাওয়া যায় না।
মধু আহরণে প্রতিবছর বন বিভাগের একটি লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বন বিভাগ সূত্র জানায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু আহরণ করা হয়েছিল ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে ৩ হাজার ৮ কুইন্টাল হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। তবে চুরি করে আহরণ করা মধু বন বিভাগের হিসাবের বাইরে থাকে। অন্যদিকে আগাম চাক কাটার কারণে মৌসুমে মধুও কম পাওয়া যায়। এর ফলে বন বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়।
কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের অবসারপ্রাপ্ত অধ্যাপক আ ব ম আব্দুল মালেক বলেন, ৫ আগস্টর পর থেকে আবারো সুন্দরবনে বনদস্যুদের অত্যাচার বেড়ে গেছে। ছোট-বড় মিলে বেশ কয়েকটি দস্যুদল বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রায়ই শোনা যায়- বনদস্যুদের হাতে জিম্মি হচ্ছে জেলে-বাওয়ালীরা। বনের গহীনে যেখানে মাধু আহরণ করছে সেখানে সাপ, বাঘ, অনন্য ভয়ানক প্রানীর উপস্থিতি যেমন থাকে, তেমনি বনদস্যুরা তাদের কাছ থেকে অর্থ ও তাদের অন্য সামগ্রী ছিনতাই করে নিচ্ছে। এসব কারণে তাদের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে এবং জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। আমরা চাই সরকার এ বনদস্যুদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিক। যাতে সুন্দরবন নির্ভরশীল জেলে-বাওয়ালী ও মৌয়ালরা বনে গিয়ে নিরপদে মাছ-মধু আহরণ করতে পারে।
এ বিষয়ে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এজেড এম হাসানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে মধু আহরণের জন্য বন বিভাগের টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া এবার বন্যপ্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মৌয়ালদের সাবধানে চলাফেরার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, এ বছর পশ্চিম সুন্দরবনে ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু ও ৬০০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুলনা রেঞ্জের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৫০ কুইন্টাল মধু ও ২০০ কুইন্টাল মোম।