আজকের চ্যালেঞ্জ, আগামী দিনের আশা

2 weeks ago 10

এই পৃথিবী, যে পৃথিবীটি প্রতিদিন তার অনুষঙ্গে নানা পরিবর্তন দেখতে পায়, আজ সে একই পৃথিবী—যেখানে অমানবিকতা, সহিংসতা, এবং নির্দয়তা আমাদের চারপাশে ক্রমাগত বিস্তার লাভ করছে। একদিকে সভ্যতার অগ্রগতি, অন্যদিকে মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিকতা—এই যেন দুই ধারা একে অপরের সঙ্গী হয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতি আমাদের কাছে এক গভীর প্রশ্ন রেখে যায়: আমরা কি সত্যিই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? যেখানে প্রতিনিয়ত মানুষ তার ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্য মানুষের প্রতি নিষ্ঠুরতা এবং প্রতারণা করছে, সেখানে কি মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা, এবং সহানুভূতির স্থান আছে?

বিশ্বব্যাপী নানা দেশে সরকারি বাহিনী এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুরক্ষিত, কিন্তু প্রশ্ন দাঁড়ায়, মানবাধিকার রক্ষা করতে কোনো বিশেষ মন্ত্রণালয় বা ব্যবস্থা কই? অস্ত্রের বিশাল শক্তি, নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পনা, শাসনের খুঁটি কোথাও মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থাপনা কি নেই? কেন নয়? আমাদের বিবেক কি এই অস্বস্তি অনুভব করে না?

মানবাধিকার দিবসের অর্থ

প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসের আয়োজন করা হয়, কিন্তু এটির বাস্তবতা নিয়ে একেবারেই নতুন প্রশ্ন ওঠে। এটি শুধুই কি একটি অনুষ্ঠান, যেখানে কয়েক ঘণ্টার আলোচনা এবং বক্তৃতার মধ্যেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? নয়তো এটি একটি চলমান সংগ্রাম, যা দিনপঞ্জিকায় প্রতিদিনই আমাদের তাড়িত করবে? আমরা তো জানি, এই দিবস উদযাপন শুধুমাত্র একটি চিহ্নিত দিনের বিষয় নয়—এটি একটা চলমান লড়াই, যা পুরো বছর ধরে বিস্তার লাভ করবে। একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিদিনের ঘটনা, অন্যদিকে একদিনের উদযাপন কি এদের মোকাবিলা করতে পারে?

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা এবং শান্তির প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচুর প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু তাদের চেষ্টার পরও প্রশ্ন থেকেই যায়—তাদের প্রচেষ্টা কতটুকু সফল? বাস্তবতা আর তাত্ত্বিক আলোচনা—এ দুটি দূরত্বের মাঝে যে পার্থক্য, তা আমাদের সমাজের দুঃখজনক সত্য। যখন আমাদের চারপাশে প্রতারণা, শোষণ, অবিচার এবং নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট, তখন কীভাবে আশা করতে পারি যে, পৃথিবী একদিন শান্তি, সমতা এবং মানবিকতার ছবিটি ধারণ করবে?

মানবাধিকার: বাংলাদেশের বাস্তবতা

বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য নানা বিধান রাখা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে।’ কিন্তু এই সংবিধান, আমাদের আস্থা, বা আদালতের রায় কি সবসময় বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? আমাদের সমাজে কি মানবাধিকার খণ্ডিত হয়ে যায় না? যখন এক মেধাবী ছাত্র শুধু তার রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়, কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকে, তখন সেই ক্ষোভ কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হয় না? আদিবাসীদের প্রতি বৈষম্য, শিশু শ্রম—এগুলোই কী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল নয়?

বিশ্বজুড়ে মানবাধিকার দিবসের উপলক্ষ

এ বছরও মানবাধিকার দিবস নানা আলোচনা, সেমিনার এবং সচেতনতা বৃদ্ধি কর্মসূচির মাধ্যমে পালিত হচ্ছে, তবে বাস্তবে আমরা কি সত্যিই উপলব্ধি করতে পারছি, কোথাও এখনও মানুষ সঠিকভাবে মানবাধিকার পাচ্ছে না? নারী, শিশু, আদিবাসী, সংখ্যালঘু—এরা প্রতিদিন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, সহিংসতার শিকার হচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশু শ্রম, দারিদ্র্য—এগুলি আমাদের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মানবাধিকার কি কেবল ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়ে শেষ হবে’, নাকি সারা বছরের উদ্যোগে একটি মানবিক সমাজ গড়া হবে?

সত্যিকারের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পথে

বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটি কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ। দিনের এক মুহূর্তে মানবাধিকার দিবস উদযাপন করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে না। পুরো বছর ধরে আমাদের সকল পদক্ষেপেই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তবে, আমরা যদি আমাদের আচার-ব্যবহার, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং নৈতিকতার মধ্যে মানবিকতা ও সহানুভূতির আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তবে সমাজে কোনো পরিবর্তন আসবে না।

এখন, ১০ ডিসেম্বর আমাদের সামনে আসে। আসুন, এই দিনটিকে শুধু আলোচনা কিংবা বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, প্রতিটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে দাঁড়াই। আমাদের উচিত সক্রিয়ভাবে মানবাধিকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং সবাইকে অধিকার ভোগের সুযোগ দেওয়া। মানবাধিকার দিবসের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল মানুষের সেবা, সম্মান এবং সমর্থন দেওয়া। আসুন, আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই সমাজ গড়ে তুলি, যেখানে সমতা, ন্যায্যতা এবং মানবিকতা একে অপরকে আশ্রয় দেবে।

একদিন, যখন সত্যিকারের মানবাধিকার সবার কাছে পৌঁছাবে, যখন মানুষ তার অধিকার পাবে, তখন পৃথিবী সত্যিকার অর্থে শান্তির প্রতিচ্ছবি হবে। আজকের এই মানবাধিকার দিবসে, আসুন আমরা শপথ করি—শুধু আমাদের অধিকার নয়, অন্যের অধিকারও রক্ষায় সচেষ্ট হব। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটি উন্নত, সহানুভূতিশীল এবং সমতাভিত্তিক পৃথিবী গড়ার দিকে আমরা সবাই এগিয়ে চলি।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
[email protected]

এমআরএম/এএসএম

Read Entire Article