গণহত্যা বা জেনোসাইড গবেষণার বিষয় হিসেবে এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিদেশেও এ বিষয়ে অনেক প্রকল্প নেয়া হচ্ছে। প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট শুরু হওয়ার পর তরুণরা আরো বেশি গণহত্যা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠছে। জেনোসাইড- এর বাংলা হিসেবে যখন গণহত্যা ব্যবহার করি তখন আমার থেকে বয়সে কম, মেধাবী গবেষকরা সন্তুষ্ট হন না। তাঁরা বিদেশে পড়াশোনা করছেন, বিদেশি অর্থায়নে বা দেশি অর্থায়নে, সারাক্ষণ ইন্টারনেট খোঁজেন, অনেক জানেন, বোঝেন, তাদের আপত্তি জেনোসাইড-এর বাংলা গণহত্যা হয় না। কী হয়? কিছুই হয় না।
জেনোসাইড বোঝাতে জেনোসাইড-ই বোঝাতে হবে। হ্যা, ম্যাসাকার-কে গণহত্যা বলা যেতে পারে। ম্যাসাকার কিন্তু জেনোসাইড না। আমার অবস্থা ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দের’ অবস্থা। এতো কষ্ট করে আমরা গণহত্যা জাদুঘর করলাম যা পরিচিত জেনোসাইড মিউজিয়াম হিসেবে এখন দেখি এর নাম করতে হবে নাকি ‘ম্যাসাকার মিউজিয়াম’? ১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষেরও বেশি হত্যাকে বাংলাদেশ হলোকাস্ট বলা যাবে? ইহুদি হত্যা করলে যদি ‘হলোকাস্ট’ হয়, বাঙালি হত্যা করলে তা হলোকাস্ট হবে না কেনো? গবেষকরা জেনোসাইডের আদি লাতিন শব্দ কেনো ব্যবহার করছেন না কে জানে কেনো।
যেহেতু আমি পন্ডিত নই এবং এ বলে কোনো খ্যাতিও, নেই এর প্রধান কারণ ভাষা ঘাটতি। ইংরেজিতে এ বিষয়ে আমার প্রবন্ধ নেই, বক্তৃতা নেই। তবে, এ ভূখন্ডের সাধারণ মানুষ হিসেবে ১৯৭১ সালের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড তখন আমরা নিছক হত্যা বা খুন হিসেবেই দেখেছি। তারপর জেনোসাইড শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। এর বাংলা করা হয়েছিল গণহত্যা। আমি যখন জেনোসাইড বলি তখন গণহত্যাকেই বুঝি। হলোকাস্টও কি গণহত্যার মধ্যে পড়ে না? ম্যাসাকার বললে মনে গণহত্যার আদল আসে না। আমি আমার ভাষায় গণহত্যা বুঝি এবং ইংরেজি জেনোসাইড না বললে তা ভুল হয় না। সারা বাংলাদেশে জরিপ চালিয়ে দেখেন, গণহত্যা বললে ৩০ লক্ষেরও বেশি হত্যাকেই বোঝে। ম্যাসাকার বোঝে না।
পাশ্চাত্যে ব্যবহৃত এই সব শব্দের খেলা নিয়ে খেলতে আমরা খুব ভালোবাসি। বাংলাদেশ হওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল, বিচারকরা কোনো বাংলায় রায় দেন না। এবং দীর্ঘদিন তারা এ বিষয়ে কর্ণপাত করেন নি। কারণ, আইন নাকি ইংরেজিতেই পড়তে হয়। বাংলা করলে একটু ভুলের জন্য কারো গলায় দড়ি পড়তে পারে, আবার কেউ দড়ি থেকে মুক্তি পেতে পারে। প্রয়াত গাজী শামছুর রহমান এক গাদা আইনের বই অনুবাদ করে দেখিয়েছিলেন, বাংলায় আইন লিখলে তার ব্যত্যয় হয় না।
‘গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি’ এখন বেশ একটা চালু শ্লোগান। অর্থাৎ, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে গণহত্যা হলো তার স্বীকৃতি কেনো পাচ্ছে না বাংলাদেশ? এ নিয়ে রাজনীতিবিদদের হাহাকার, পন্ডিতদের কলম কামড়ানো, যুবকদের আর্তনাদ চতুর্দিকে। এতে সাড়া দিয়ে বিদেশি অনেক সংস্থাও এগিয়ে আসছে এ নিয়ে গবেষণা করতে।
কয়েকমাস আগে আমেরিকার দু’একটি এনজিও বা সংস্থা বাংলাদেশে গণহত্যা বলে হয়েছে দাবি করেছে। হায় আল্লাহ্, সে কি উল্লাস বাংলাদেশের সাংবাদিকদের। একি যাতা ব্যাপার! শ্বেতাঙ্গ ককেশিয়রা বলেছেন, বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া গেল। আচ্ছা, কেউ যদি, বিশেষ করে শ্বেতাঙ্গ ককেশিয়রা যদি বলে, বাংলাদেশে গণহত্যা হয় নি, তাহলে কি প্রমাণিত হবে না আমাদের সরকারকে বলতে হবে, ঠিকইতো বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি, খানিকটা ম্যাসাকার হয়ত হয়েছে। যেমন, তারা বলছে, প্যালেস্টাইনে তো গণহত্যা হচ্ছে না, সেখানে টেররিস্ট নিকেশ চলছে। তাহলে কি আমাদের মেনে নিতে হবে তাদের ভাষ্যই সঠিক। প্রশ্ন করা ও যাবে না?
এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, রাজনীতির শ্লোগান হয়ে দাঁড়াচ্ছে তা। বিষয়টি একেকজন একেক রকম ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। আমি অনেক নীতি নির্ধারকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মতে, বিদেশি পার্লামেন্টে যদি বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রস্তাব পাস হয় তাহলে, এক ধরনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হয়। যেমন, কানাডার সংসদে, আর্মেনিয়ার গণহত্যার ওপর একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। এতে তুরস্ক খুব ক্রোধান্বিত হয়েছিল।
ঐ সময় শাহরিয়ার কবির আর্মেনিয়ায় গিয়েছিলেন এবং আর্মেনিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বাংলাদেশ সফরে আসতে আগ্রহী এবং তাদের সংসদে এ বিষয়ে প্রস্তাব তুলতে পারেন। শাহরিয়ার এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করলে তিনি বলেছিলেন, পাগল, তুরস্কের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলারের, সেটা বন্ধ হয়ে যাক আর কি! তুরস্ক রাগলে কানাডার কিছু আসে যায় না, কিন্তু বাংলাদেশের আসে যায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন দেশের সংসদ এতে এগিয়ে আসবে? কেউ নয়।
আচ্ছা, এটা অন্যভাবে দেখা যাক। ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ তো বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র। তাদেরই প্রথম অনুরোধ করা যাক না, এধরনের একটি প্রস্তাব পাস করতে। দেখা যাক তারা কী করে। কিন্তু, সে বিষয় বোধহয় সরকারের চিন্তার বাইরে। গত সপ্তাহে এধরনের একটি ওয়ার্কশপে, আমার প্রাক্তন সহকর্মী, মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মীজানুর রহমান চমৎকার একটি মন্তব্য করেছিলেন- বললেন, এই ওয়ার্কশপে যদি আজ ফ্রান্স বা জার্মানি বা আমেরিকার দু’একজন আসতেন তাহলে তাহলে এটিকে বলা হতো আন্তর্জাতিক ওয়ার্কশপ। ভারত নেপাল ভুটান এলে বলা হবে সাউথ এশিয়ান ওয়ার্কশপ। ধরে নিতে পারি সরকার সাউথ এশিয়া নয় ইন্টারন্যাশনালে আগ্রহী যা কখনও ফলবতী হবে না।
অনেকে আবার সুনির্দিষ্টভাবে বলছেন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মানে জাতিসংঘের স্বীকৃতি। এখানেও বিভ্রান্তি আছে। অনেক নীতি নির্ধারক মনে করেন, জাতিসংঘের উচিত ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস উদযাপনের আহবান জানানো। যেমন, ইউনেসকো ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ওরা ভুলে যান জাতিসংঘে গণহত্যা দিবস পালনের ঘোষণা করেছে ১৯৪৮ সালে।
তাহলে? জাতিসংঘ ঘোষণা করুক, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল। যেমন, মাসখানেক আগে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে জুলাই ১৯৯৫ সালে বসানিয়ায় ৮০০০ মুসলমানকে হত্যা করেছিল সার্বিয়ান সেনাবাহিনী। [স্রেবেনিকা গণহত্যা] রুয়ান্ডার গণহত্যাকেও অনুরূপ স্বীকৃতি দিয়েছে। তাহলে, বাংলাদেশের ৩০ লক্ষ হত্যাকে স্বীকার করা হয় না কেনো? এর মধ্যে একটা রাজনীতি তো আছেই। যেমন, এখন খৃস্টানরা প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট চালাচ্ছে পুরোদমে, মুসলামন রাষ্ট্রগুলি তাতে অনুমোদন দিয়েছে যদিও সাধারণ খৃস্টান, মুসলমান, ইহুদীদের অনেকে এ কারণে চরমভাবে ক্ষুব্ধ। স্রেবেনিকার গণহত্যার অনুমোদনের জন্য হার্জিগোভিনা বসনিয়া অনেকদিন চেষ্টা করছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও তার বন্ধুরা দেখছে, সার্বীয়দের মুসলমান গণহত্যা যদি তারা স্বীকৃতি দেয় তাহলে তাদের মুসলমান বিরোধী বলা যাবে না। প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট তাহলে ধর্মের কারণে হচ্ছে না এটা বোঝানো যাবে। পাশ্চাত্য মুসলমানদের ভালোবাসে দেখেইতো এ প্রস্তাব সায় দিয়েছে। এতোদিন এ প্রস্তাব তারা সায় দেয়নি। অর্থাৎ, গণহত্যা একেবারে রাজনীতির বাইরে নয়।
শাহরিয়ার কবির যখন ইউরোপ বা আমেরিকা গেছেন তখন নির্মূল কমিটির এবং বাংলাদেশের সিভিল সমাজের পক্ষ থেকে বা রাষ্ট্র থেকে এধরণের প্রস্তাব তোলা যায় কিনা তা নিয়ে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা প্রশ্ন রেখেছেন, তোমরা গণহত্যা স্বীকার কর কিনা? সে দিবস পালন করো কিনা? বা তোমাদের প্রধানমন্ত্রী বা রাজনৈতিক দল [বিএনপি+জামায়াত; খালেদা জিয়া] তারাইতো বলছে এত হত্যা হয় নি। বলা বাহুল্য, শাহরিয়ার কবিরের পক্ষে এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশে নির্মূল কমিটি দু’দশক ধরে গণহত্যা দিবস পালন করে আসছিল। এসব শোনার পর ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমি এবং শাহরিয়ার গণহত্যা নিয়ে লেখালেখি শুরু করি ও ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সরকারের কাছে আবেদন নিবেদন করতে থাকি। এর মধ্যে শেখ হাসিনা সরকার গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার শুরু করলে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হয়। বছর কয়েক আগে সরকার ২৫ মার্চ সরকারি ভাবে গণহত্যা দিবস পালন শুরু করে। শেখ হাসিনা না থাকলে গণহত্যার ভিকটিমরা এ স্বীকৃতিটুকুও পেতেন না।
ইসরায়েল যে গণহত্যা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তা স্বীকার করছে না। কিন্তু তাতে গণহত্যা যে হচ্ছে না তা তো নয়। এই প্রথম গণহত্যা লাইভ দেখানো হচ্ছে। বিশ্ব সিভিল সমাজ বলছে গণহত্যা হচ্ছে। সেটিই স্বীকার করে নিয়েছে সবাই। সেটিই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দু’নম্বরী ব্যাখ্যা কেউ মানছে না।
এখন জাতিসংঘে কাকুতি মিনতি করলেই কি তা হবে? দু’দশক আগে থেকে আমরা ও নির্মূল কমিটি বহুবার সরকারে আবেদন জানিয়েছি জাতিসংঘের স্বীকৃতির জন্য। তেমন সাড়া পাওয়া যায় নি সরকার থেকে। ধরা যাক, সরকার এখন আদা জল খেয়ে নেমে গেল জাতিসংঘে তদবির করতে। কিন্তু, সম্ভব হবে না। কারণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কাজ করার জন্য ইকুইপড নয়।
প্রথম, গণহত্যা বিষয় তথ্য উপাত্ত আছে পররাষ্ট্র দপ্তরে? দুই, আমার খেয়াল আছে, বিদেশিদের সম্মাননার কাজটি যখন শুরু করি তখন ডা. দীপু মণি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁকে অনুরোধ জানালাম, এ তালিকাটি প্রথমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই তৈরি হোক। তারা যে তালিকা তৈরি করল তাতে প্রথমেই দেখা গেল উ থান্টের নাম। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব। এবং বাংলাদেশের পক্ষে কোনো কাজ তো দূরে থাকুক হাঁক-ডাকও করতে পারেন নি।
তৃতীয়: এসব কাজ করার জন্য সাধারণত মন্ত্রণালয় একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেয়, তারা কাজ করে। বাংলাদেশের একমাত্র, এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম, দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র গণহত্যা জাদুঘরকে তারা কখনও ডাকেনি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যৌথভাবে গণহত্যা দিবস পালন করে কিন্তু কখনও গণহত্যা জাদুঘরকে ডাকা হয় নি। যারা দীর্ঘদিন গণহত্যা নিয়ে কাজ করছেন তাদের খোঁজও তারা পান নি। বিচারপতি মানিক এ বিষয়ে একবার একটি নিবন্ধে লিখেছিলেন, আমলাতন্ত্র সব সময় ভুল ব্যক্তিটিকে বাছাই করে।
সুতরাং, এ কাজটি শুরুর আগে যারা গণহত্যা নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন, গণহত্যা জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং তাদের নিজস্ব অফিসার নিয়ে কমিটি তৈরি করে কর্মকৌশল তৈরি করতে হবে। তারপর কাজে নামতে হবে।
কাজে নামলেই কি হবে? এক্ষেত্রে ৯৯ ভাগ না হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে। জাতিসংঘে প্রায় সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানী, যুক্তরাজ্য ও তাদের ইউরোপীয় সতীর্থরা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পক্ষে একথা পাগলও বলবে না। বাংলাদেশের গণহত্যায় সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। চিন ও সৌদী আরব। বাকীরা মৌনীবাবার ভূমিকায় ছিল। মুসলিম অধ্যুষিত সবচেয়ে বড় দেশ ইন্দোনেশিয়ায়ও বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল।
তাহলে, এখন জাতিসংঘে গণহত্যা স্বীকৃতির জন্য তদবির করলে তারা সানন্দে মেনে নেবে? পাকিস্তান নিশ্চয়ই ঢেড়শ ভাজবে না। তার মুসলমান বন্ধুদের নিয়ে আবার বাংলাদেশের বিপক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে, যে বললাম, একভাগ চান্স আছে। বছর দশেকের মধ্যে নিশ্চয় পরিস্থিতি বদলাবে। প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র কাজ করবে, প্যালেস্টাইন হলোকাস্টের স্মারক নির্মিত হবে তখন ইসরায়েল লবি ও তাদের সহায়তাকারীরা খানিকটা নমিত হবে তখন বাংলাদেশ হয়ত গণহত্যা স্বীকৃতি পেতে পারে।
তাহলে বিকল্প কী? বিকল্প একটি আছে এবং আমার মনে হয়েছে এটি যুক্তিযুক্ত। কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ওয়ার্কশপেও অনেকে এটি সমর্থন করেছেন। সেটি হলো নাগরিক স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতির দুটি দিক আছে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক।
দুঃখের হলেও এটি সত্যি যে, বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ, কমপক্ষে ৩০ ভাগ বাংলাদেশের গণহত্যা প্রশ্নবিদ্ধ করতে প্রস্তুত। এরা বিএনপি-জামায়াত ও নানা ধর্মব্যবসায়ী দলের অনুসারী। এদের নেতা খালেদা জিয়া। এরা বঙ্গন্ধুকেও স্বীকার করে না। এরা বিভিন্ন স্থানে এবং মানসজগতে পাকিস্তানি ছিটমহল তৈরি করেছে। দেশের মানুষের একটি বড় অংশ গণহত্যা সম্পর্কে জানে না। আগে এ বোঝা সরাতে হবে। পাঠ্যসূচিতে গণহত্যায় গুরুত্ব দিতে হবে।
বিভিন্ন এলাকার গণহত্যা, যন্ত্রণালয়, গণকবর ও বধ্যভূমির একটি মানচিত্র তৈরি করেছে গণহত্যা জাদুঘর। সেটির ওপর ভিত্তি করে সরকার ও সিভিল সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এনজিওদের ছোট ছোট স্মারক সেখানে নির্মাণ করতে হবে। যে স্মারকে জমি লাগে কম, নির্মাণ ব্যয় কম, সে রকম স্মারক। নিদেনপক্ষে একটি ফলক। এরকম ৫০টি ফলক গণহত্যা জাদুঘর নির্মাণ করেছে। এবং স্থানীয়ভাবে তা অভিঘাত সৃষ্টি করছে। তাহলে প্রজন্ম ও যারা এ বিষয়ে জানে না, তারা জানবে, কৌতুহলী হবে, আগ্রহী হবে।
গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর নিয়মিতভাবে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সেমিনার করে। যারা বিদেশ থেকে আসছেন তারা বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে কাজ করছেন। এভাবে ভুলে যাওয়া গণহত্যা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। গণহত্যা হয়েছিল তাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে খুলনায় গণহত্যা জাদুঘর। তাদের জার্নাল, গ্রন্থরাজি, জিপিএস সার্ভে, ডিজিটালাইজেশন এখন নাগরিক স্বীকৃতির ব্যাপারে ব্যাপক অবদান রাখছে।
২৫ মার্চ বিদেশস্থ আমাদের দূতাবাসগুলিতে ভালোভাবে গণহত্যা দিবস পালন করা জরুরি। আমাকে ভারতের সাংবাদিক মানস ঘোষ জানালেন, কৃষ্ণেন্দু বসু বাংলাদেশের গণহত্যার ওপর যে চমৎকার ডকুমেন্টারিটি তৈরি করেছেন তাতে খানিকটা সহায়তার জন্য অনেক অনুনয় বিনুনয় করেছেন, কাজ হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন, গ্রামে গঞ্জে এটি দেখানো হোক। হয়নি। এর ফলাফল কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষেই যেত।
এমনকী নিউইয়র্কে তিনি যখন এটি দেখান তখন আমন্ত্রণ সত্বেও বাংলাদেশ মিশনের কেউ আসেন নি। দেশ-বিদেশের অনেকে বলেন, আমলাতন্ত্র আর আওয়ামী সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। কী জানি, আদার বেপারির জাহাজের খবরে দরকার কি! তবে, বর্তমান তথ্যমন্ত্রী তরুণ, যুক্ত ছিলেন নির্মূল কমিটির সঙ্গে, মানবতা বিরোধী অপরাধ বিচার আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। কৃষ্ণেন্দু হয়ত তার সহানুভূতি পেতে পারেন।
শুধু তাই নয়, এসংক্রান্ত কাগজপত্র প্রবাসী ও বিদেশিদের বিতরণ করতে হবে। এধরনের বিভিন্ন কার্যক্রমের ফলে, বাংলাদেশের গণহত্যা তাদের পাঠক্রমে, আলোচনায়, কোষগ্রন্থে স্থান করে নেবে। সেটি হচ্ছে আসল স্বীকৃতি। ধরা গেল, জাতিসংঘ প্রস্তাব পাস করল ২৫ মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল। তাতে কী হলো? এরকম হাজার হাজার প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু আলোচনায় না থাকলে সেটি স্বীকৃতি হয় না।
রুয়ান্ডা, স্রেবেনিকার গণহত্যা নিয়ে আলোচনা হয় যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপ তা চায়। বাংলাদেশ নিয়ে তারা আলোচনা চায় না কারণ, এতে তারা ছিল জড়িত। পরিস্থিতি ৫০ বছরে খুব একটা বদলায় নি। প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় সাধারণ মানুষ পথে নেমেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাথী মোড়লদের মনোভাব একই রকম ছিল। কিন্তু আজকের মতো তখনও বিশ্ব সিভিল সমাজ পথে নেমেছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপকে পিছু হটতে হয়েছে। ঐ স্মৃতি শুধু আমাদের ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্ব সিভিল সমাজে। ইসরায়েল বা ইহুদীরা যেটি করেছিল।
বিশ্ব সিভিল সমাজ ও নিজের দেশের স্বীকৃতিই সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি। ইসরায়েল যে গণহত্যা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তা স্বীকার করছে না। কিন্তু তাতে গণহত্যা যে হচ্ছে না তা তো নয়। এই প্রথম গণহত্যা লাইভ দেখানো হচ্ছে। বিশ্ব সিভিল সমাজ বলছে গণহত্যা হচ্ছে। সেটিই স্বীকার করে নিয়েছে সবাই। সেটিই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের দু’নম্বরী ব্যাখ্যা কেউ মানছে না।
লেখক: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জিকেএস