শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানের সময়কার দিনলিপি ও কর্মকৌশলের বর্ণনা দিয়েছেন নতুন রাজনৈতিক সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশের (আপ বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ।
ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেন, ‘গত বছরের ২০ জুলাই সকালে আমরা কারফিউ ভেঙে রাস্তায় বের হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাই। আন্দোলনে কর্মসূচির ৯ দফা নির্ধারণ করে তা পেনড্রাইভে করে বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে পাঠানো হয়। আমি সমন্বয়ক আসিফ ও সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথা বলে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ৬ আগস্টের পরিবর্তে একদিন এগিয়ে আনার পরামর্শ দিই।’
হত্যা মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আজ রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জবানবন্দিতে প্রসিকিউশনের ৪৮তম সাক্ষী হিসেবে জুনায়েদ এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা ও রাজাকারের নাতিপুতি বলেন। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে সারারাত প্রতিবাদ করতে থাকেন। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দমনে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল ইসলাম শয়ন বলেছিলেন, ‘ছাত্রলীগ ফু দিলে আন্দোলনকারীরা ৫ মিনিটেই উড়ে যাব ‘। ওই দিন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম বলেছিলেন, ‘আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে, কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে এবং সবকিছু মনে রাখা হবে’।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর ছাত্রলীগ নির্মমভাবে সশস্ত্র হামলা চালায়। আহত ছাত্রছাত্রীদের হাসপাতালে যেতে বাধা দেওয়া হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্রছাত্রীদের চিকিৎসায়ও বাধা দেওয়া হয়। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসারত আহত ছাত্রছাত্রীদের ওপর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈকতের নেতৃত্বে হামলা চালানো হয়।
তিনি আরও বলেন, এই হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই সারাদেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাকা হয়। ছাত্রছাত্রীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়। এরই মধ্যে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলায় রংপুরে আবু সাঈদ, চট্টগ্রামে ওয়াসিম, শান্ত ও ফারুকসহ মোট ৬ জনের শহীদ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
এই দিনই সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং পরদিন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ১৭ জুলাই আগের দিনের ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিলের আয়োজন করা হয়। গায়েবানা জানাজার পূর্বেই রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আক্তার হোসেনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কফিন মিছিলে পুলিশ হামলা চালায়।
১৮ জুলাই আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ গুলি করে অনেককে হত্যা ও জখম করে। আহতদের বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সে গুলি করা হয়। সেদিন রাতেই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই আমি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকাধীন চিটাগাং রোডে আন্দোলনরত অবস্থায় ছিলাম। সকালে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গাড়িবহর নিয়ে সেখানে আসে। বিকেল আনুমানিক ৪টায় হাসপাতালের সামনে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করলে সেখানে ২ জন নিহত হয়। বেশ কয়েকজন আহত হয়। তখন আন্দোলনকারীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং মিছিল করতে থাকে। চিটাগাং রোডের সামনে হেলিকপ্টার থেকে মিছিলের ওপর গুলি চালানো হয়। সামনে থেকে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরাও গুলি চালান। সেখানে ২০/২৫ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও আহত হয়। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই। সেখানে টানা ৩ ঘণ্টা গুলি চলে। সেদিন রাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগ বাসায় বাসায় গিয়ে আন্দোলনকারীদের খুঁজতে থাকে।
সেদিন রাতে কারফিউ জারি করা হয় জানিয়ে জুনায়েদ বলেন, ২০ জুলাই সকালে আমরা আন্দোলনকারীরা কারফিউ ভঙ্গ করে আবার রাস্তায় বের হই এবং আন্দোলন চালিয়ে যাই। আন্দোলন কর্মসূচির ৯ দফা নির্ধারণ করে পেনড্রাইভে করে তা বিভিন্ন মিডিয়ার কাছে পাঠানো হয়। আন্দোলন থামানোর জন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়। বলা হয়, যেহেতু ২১ জুলাই কোটা সংস্কার বিষয়ে আপিল বিভাগে একটি আদেশ হওয়ার কথা আছে, সেহেতু ছাত্রদের আন্দোলন বন্ধ করতে বলা হয়।
২১ জুলাই ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সেখানে গণহত্যার দায় স্বীকার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানানো হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দুজন মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে যাত্রাবাড়ী থেকে চিটাগাং রোড এলাকায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয় ও কয়েক শতাধিক আহত হয়। এ সময়ের মধ্যে ১৩৪ জনের মরদেহ বেওয়ারিশ হিসেবে রায়ের বাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।
প্রথমে নাহিদ ইসলামকে গুম করে রাখা হয় এবং ২১ জুলাই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আবার তাকেসহ মোট ৬ জন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে তুলে নেওয়া হয়। এসময় গণগ্রেফতার চলতে থাকে। ২ শতাধিক মামলায় প্রায় ২ লক্ষাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। সরকার পক্ষ থেকে ৩০ জুলাই শোক দিবস ঘোষণা করা হলে আমরা আন্দোলনকারীরা তা প্রত্যাখ্যান করি। আন্দোলনকারীরা সরকার ঘোষিত শোক দিবস পালন কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে চোখে মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ কর্মসূচি গ্রহণ করি এবং ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার আহ্বান জানাই। ফেসবুক প্রোফাইল লাল করার কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সাড়া পড়ে এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের ফেসবুক প্রোফাইল লাল হয়ে যায়।
৩১ জুলাই গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে আদালত অভিমুখে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করা হয়। পুলিশ এ কর্মসূচিতে বাধা দেয়। এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শেহরিন আমিন মোনামিসহ অনেকেই আহত হন। ১ আগস্ট ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি পালন করা হয়। একই সঙ্গে আমরা ১ আগস্টকে ৩২ জুলাই হিসেবে গণনা করার সিদ্ধান্ত নিই। পরবর্তী আগস্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত ৩৬ জুলাই হিসেবে গণনা করা হয়। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের ১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন নাহিদ ইসলাম। আমিসহ আরও অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
তিনি বলেন, ওই বছরের ৪ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন চালিয়ে যাই। সেদিন পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগ সম্মিলিতভাবে আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সেদিন অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত ও আহত হয়। ওই দিন প্রথমে ৬ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। আমি সমন্বয়ক আসিফ ও সাদিক কায়েমের সঙ্গে কথা বলে কর্মসূচি এগিয়ে আনার পরামর্শ দিই। ৪ আগস্ট রাতে সমন্বয়ক আসিফ মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দেন। ৫ আগস্ট সকাল ৯টার সময় আমি বাসা থেকে বের হয়ে আন্দোলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে যাত্রাবাড়ীর দিকে রওনা হই। আমার সঙ্গে আরও ৭/৮ জন ছিল।
সাক্ষী আরও উল্লেখ করেন, ঢাকা চট্টগ্রাম সিলেট রোডের সাদ্দাম মার্কেটের সামনে অনেক আন্দোলনকারী জড়ো হয়। আমিও তাতে যুক্ত হই। সেখান থেকে মিছিল সহকারে আমরা কাজলা ফুটওভার ব্রিজের সামনে গিয়ে অবস্থান গ্রহণ করি এবং আন্দোলন চালিয়ে যাই। আন্দোলনকারীদের ওপর স্নাইপার রাইফেল দিয়ে টার্গেট করে মাথায় গুলি করা হয়।
আমি প্রায় ১৫ জনকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অনাবিল হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে দেখেছি। আমরা জানতে পাই যে, ২টার দিকে সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তখন আমরা আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারি যে, শেখ হাসিনা সম্ভবত ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। আমি হ্যান্ড মাইকে আন্দোলনকারীদের মাঠ ছেড়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। যাতে দেশে সামরিক শাসন আসতে না পারে সেজন্য সজাগ থাকতে। বিকেল ৩টার দিকে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন বলে ঘোষণা দেন।
সেদিন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত যাত্রাবাড়ী থানার আশপাশ থেকে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। আমি এই হত্যাকাণ্ডের জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের সবার বিচার চাই।
এফএইচ/এমআইএইচএস/জিকেএস