জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
এ সময় একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সংঘটিত হত্যা, গণহত্যার ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালে ট্রাইব্যুনালের তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম ও প্রয়াত প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুমের স্কাইপ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে কথা বলেন।
তিনি বলেন, তৎকালীন বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুমকে আগেই বলে রেখে ছিলেন- ‘আপনি দাঁড়িয়ে যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু। সবাই মনে করবে আমাদের খাতির নেই’
সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) তৎকালীন ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে এসব কথা তুলে ধরেন ৪৬তম সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে মাহমুদুর রহমান সাক্ষীর জবানবন্দি পেশ করেন মাহমুদুর রহমান।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, শাপলা চত্বরে গণহত্যার কিছুদিন আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচার চলছিল। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ছিলেন নিজামুল হক নাসিম। তিনি বিচারের নামে যে অবিচার করেছিলেন তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপিয়েছিল দৈনিক আমার দেশ ও লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা। নিজের বেঞ্চের মামলা নিয়ে বিদেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলতেন বিচারপতি নিজামুল হক। তাদের স্কাইপ কথোপকথনের প্রমাণ ও ইমেইল আমার দেশ ও ইকোনমিস্টের কাছে পৌঁছায়।
- আরও পড়ুন:
আগের রাতে ভোট এটা বাংলাদেশেই প্রথম, বলেছিলেন জাপানের রাষ্ট্রদূত
ষড়যন্ত্র করে সেনা হত্যার পরিস্থিতি তৈরি করেন তাপসসহ আ.লীগ নেতারা
সেই কথোপকথনে দেখা যায়, একটি তামাশায় পরিণত হয়েছিল পুরো বিচারপ্রক্রিয়া। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল, বিদেশে থাকা জিয়া উদ্দিন ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল-মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করেছেন। এর একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সেটি হলো, জেয়াদ আল-মালুমকে আগে থেকেই বিচারপতি নিজামুল বলতেন- বিচার চলাকালে তিনি যেন মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে অবজেকশন জানান। পরে তাকে বসিয়ে দেবেন বিচারপতি নিজামুল। ভাষাটা এমন ছিল- ‘আপনি দাঁড়াইয়া যাবেন আর আমি বসাইয়া দিমু। সবাই মনে করবে আমাদের খাতির নেই।’
তিনি জানান, সেই স্কাইপ কথোপকথনে দেখা যায় যে, পুরো বিচার প্রক্রিয়া একটি তামাশায় পরিণত হয়েছে। সাক্ষীর জেরার প্রশ্নোত্তর থেকে শুরু করে খসড়া রায় লিখে দেওয়া পর্যন্ত বিচারপতি নিজামুল হক, বেলজিয়ামে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিক জিয়া উদ্দিন আহম্মেদ এবং ট্রাইব্যুনালের সরকার পক্ষের আইনজীবী জিয়াদ আল মালুম নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে আগে থেকেই নির্ধারণ করছেন। এই প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া যেতে পারে।
নিজামুল হক আনেকবার আপীল বিভাগের তৎকালীন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার কাছে পদোন্নতির জন্য তদবীর করেছিলেন। উত্তরে বিচারপতি এসকে সিনহা তাকে বলছিলেন, পদোন্নতির আগে তাকে কয়েকটি রায় দিয়ে আসতে হবে। তৎকালীন আইনমন্ত্রী এবং আইন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গেও বিচারপতি এসকে সিনহা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন।
তিনি জানান, স্কাইপ কথোপকথন এবং ইমেইলে যেসব নথিপত্র পাওয়া গিয়েছিলো তাতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিলো যে, এই মামলাগুলোর রায় পূর্ব নির্ধারিত। জনগণকে বোকা বানানোর জন্য বিচারের নাটক করা হয়েছিল। স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা এবং দ্য ইকনোমিস্টে প্রকাশিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি নিজামুল হক ট্রাইব্যুনাল থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
তিনি আরও জানান, আশ্চর্যের বিষয় শান্তির মুখোমুখি হওয়ার পরিবর্তে তাকে পুরস্কৃত করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাকে হাইকোর্টে একটি বেঞ্চ দেওয়া হয়। তারপর তাকে পদোন্নতি দিয়ে আপীল বিভাগে নেওয়া হয় এবং বিচারপতির চাকরি থেকে অবসরের পরেও তাকে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান করা হয়। অর্থাৎ ফ্যাসিস্ট সরকার জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে, সবরকম অন্যায় করার অধিকার তাদের রয়েছে। স্কাইপ কেলেঙ্কারির সংবাদ আমার দেশ পত্রিকা পাঁচ দিনে পাঁচটি পর্ব প্রকাশ করতে পেরেছিল। এরপর ট্রাইব্যুনাল থেকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণে এই সংক্রান্ত সংবাদ আর ছাপানো সম্ভব হয়নি।
এফএইচ/এনএইচআর/জেআইএম