২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়ে হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ বহাল রেখেছেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদন করা হবে কি না তা পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) আপিল বিভাগের রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ তথ্য জানান অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল জব্বার ভূঁইয়া।
আবদুল জব্বার বলেন, 'আমরা এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেছিলাম। সেটি খারিজ করে আজকে আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি দেখে সিদ্ধান্ত নেব রিভিউতে যাব কি না। রিভিউ যদি করার মতো থাকে, তাহলে রাষ্ট্র রিভিউতে যাবে। কারণ এরপর আর কিছু নেই।'
আব্দুল জব্বারের সঙ্গে এসময় উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মাসুদ, মো. আক্তারুজ্জামান, মো. জহিরুল ইসলাম, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ফাতেমা আক্তার, এসএম সায়েম ভূইয়া ও সাদিয়া আফরিন।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গ্রেনেড হামলার মামলায় বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকে গত ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ খালাস দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। তা খারিজ করে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে খালাসের রায় বহাল রাখেন।
আদালতে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল জব্বার ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্লাহ। অন্যদিকে আসামিদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এসএম শাহজাহান ও মোহাম্মদ শিশির মনির।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ওই গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও কয়েক শ ব্যক্তি আহত হন। এ ঘটনায় মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র জমা দিলে বিচার শুরু হয়। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলায় অধিকতর তদন্তে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয়।
দীর্ঘ বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন আলোচিত এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন- পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, ‘কাশ্মীরি জঙ্গি’ আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জ্বল, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম ও হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ।
এছাড়া রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেকসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং আরও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। যাবজ্জীবনপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই এবং রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
একই রায়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। সেই সঙ্গে অনাদায়ে আরও ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত।
এই মামলার আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত।
বিচারিক আদালতে এ রায়ের দেড় মাসের মাথায় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্সসহ মামলার নথি হাইকোর্টে আসে। ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর থেকে ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল শুনানি শুরু হয়। হাইকোর্টের বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের বেঞ্চে শুনানি চলছিল। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর হাইকোর্ট বেঞ্চ পুনর্গঠন হলে শুনানি শেষে গত ১ ডিসেম্বর আদালত মামলার সব আসামিকে খালাস দিয়ে রায় দেন।
এফএইচ/একিউএফ/জেআইএম