গানের কবিতায় নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। তার গান গেয়ে অডিও গানের বাজারে শিল্পীরা পেয়েছেন প্রতিষ্ঠা, এমনকি প্লেব্যাকে তার গান কাটতি বাড়িয়েছে সিনেমার। কিংবদন্তিতুল্য গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের আজ জন্মদিন।
আজ (১১ ফেব্রুয়ারি) ৮৩ বছরে পা রাখলেন এ মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। এবারের জন্মদিন তেমন ঘটা করে উদ্যাপন করছেন না তিনি। কিন্তু কেন? জানতে চাইলে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘শুভাকাঙ্ক্ষীরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি সায় দিইনি। এখন দেশ অস্থির সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। এ অনুষ্ঠান নিয়ে হয়েতো কেউ একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে দিল। দেখা যাবে এটা ইস্যু হয়ে গেল। এ জন্য কোনো ধরনের অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে বারণ করে দিয়েছি। জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে যারা যারা বাসায় আসতে চাইবেন, তারা বাসায় আসবেন। এর বাইরে কোনো আয়োজন নেই।’
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ভারসাম্য রেখে হাঁটাচলা করতে পারছেন না। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেও পারেন না। কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে সমস্যা হয়। লেখাখেলিও হচ্ছে না অনেক দিন। আক্ষেপ করে তাই বললেন, ‘শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলে অনেকদিন ধরে লিখতেও পারছি না।’
নতুন প্রজন্মের তরুণরা কেমন লিখছেন? এমন প্রশ্নে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘এই প্রজন্মের কেউ কেউ খুব ভালো লিখছেন। আবার কেউ কেউ নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তা যে কী হচ্ছে, সেটা বলা মুশকিল এখনো। সময় এলে সেসব বিচার করা যাবে। এই অস্থির সময়ে এগুলো বিচার করা যায় না। এখন সব কিছুতেই অস্থিরতা দেখা যাচ্ছ। গান-বাজনাতে সেই অস্থিরতা রয়েছে।’
গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন যাত্রা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এই সময়ে দেশ নিয়ে নিজের প্রত্যাশার কথা জানতে চাইলে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, ‘দেশে দীর্ঘদিন ধরে বিনাভোটের যে ব্যাপারটি চলছিল, সেটি থেকে দেশ মুক্তি পাবে আশা করছি। এরপরের পরিস্থিতি না দেখে বাকি কথা বলা যাবে না।’
- আরও পড়ুন:
- প্রখ্যাত গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান শোনালেন জীবনের জয়গান
- স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান
মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের লেখা অধিকাংশ গানই শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। কিংবদন্তিতুল্য এ গীতিকবি শুধু আধুনিক এবং সিনেমার গান ছাড়াও দেশের গান লিখে প্রশংসিত হয়েছেন। কয়েক প্রজন্ম তার লেখা গান শুনে বড় হয়েছে। ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে’, ‘আমার বাউল মনের একতারাটা’, ‘আমাকে একটি দোয়েল বলেছে’, ‘আমার মন পাখিটা যায়রে উড়ে যায়’সহ মন ছুঁয়ে যাওয়া অনেক দেশের গান তাকে জীবন্ত কিংবদন্তি করে রেখেছে।
সিনেমার জন্য লেখা তার অনেক গান সুপারহিট হয়েছে। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ভালোবাসা যতো বড় জীবন ততো বড় নয়’, ‘এই রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে হায় তুমি কোথায়’, ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’, ‘পৃথিবীর যত সুখ-আমি তোমারি ছোঁয়াতে খুঁজে পেয়েছি’, ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, ‘কী জাদু করেছো বলো না, ঘরে আর থাকা যে হলো না’।
রফিকউজ্জামানের লেখা আধুনিক গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ‘আকাশটাতো নীল চিঠি নয়’, ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’, ‘তুমি ভয় পেও না, ভয় পেও না, আমি, চাঁদকে বলেছি আজ রাতে’, ‘সুখ-পাখিরে পিঞ্জিরা তোর খুলে দিলাম আজ’, ‘দরদিয়া, তুই যে আমার অন্তরের অন্তর’, ‘আকাশের সব তারা ঝরে যাবে’, ‘যে আমার হৃদয় করল চুরি’, ‘আজ ফিরে না গেলেই কি নয়’, ‘আমাকে দেখার সে চোখ তোমার কই গো’, ‘তুলে বান্ধি চুলরে, খোঁপায় পলাশ ফুলরে’, ‘দিন কী রাতে সাঁজ প্রভাতে, তোমারই আছি এই তো’, ‘অন্তরে কান্দন আমার, চোখে আমার জল’।
গীতিকবিতার পাশাপাশি চলচ্চিত্রের কাহিনি ও চিত্রনাট্যও লিখেছেন তিনি, যথারীতি পেয়েছেন প্রশংসা। গীতিকবি ও কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’ সিনেমার ‘হৃদয়ে এ যে কথার কাঁপন / মুখে কেন বলা হয় না’, ১৯৮৬ সালে ‘শুভদা’ সিনেমার সবগুলো গানের জন্য গীতিকার হিসেবে এবং ২০০৮ সালে নার্গিস আক্তারের ‘মেঘের কোলে রোদ’ সিনেমার জন্য কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। পরপর দুবার এই পুরস্কার পাওয়ার পর তিনি নিজেই প্রথম পত্রিকায় লিখিতভাবে জানিয়ে দেন, গানের জন্য আর কোনো পুরস্কার তিনি নেবেন না। কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, ‘যারা সিনিয়র আছি, জনপ্রিয় হয়ে গেছি, আমরা যদি পুরস্কার পেতেই থাকি, তাহলে অন্যরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলবে।’ গীতিকবিতায় অবদানের জন্য ২০২৪ সালে মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানকে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে বাংলাদেশ সরকার।
এমএমএফ/আরএমডি/এএসএম