দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ কৃষিশিল্প পণ্য লবণ। গত কয়েক বছর টানা লবণের ভালো দাম পাওয়ায় এবারো আগাম লবণ চাষ শুরু করেছেন চাষিরা। তবে এখন দাম কম পাচ্ছেন দেখে হতাশ তারা। আর্থিক লোকসান দেখলে চাষের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এমনটি হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
কক্সবাজারের ৬ উপজেলা, চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও পটিয়ার কিছু অংশে দেশের চাহিদা অনুসারে লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। হেমন্ত-শীত-বসন্ত ও গ্রীষ্মের কিছু সময় মিলিয়ে লবণ উৎপাদন মৌসুম। চলতি ২০২৪-২০২৫ মৌসুমে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। সেই হিসাব ধরেই জেলার দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় মৌসুমের প্রথম লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে চলতি মাসের (নভেম্বর) প্রথম সপ্তাহ থেকে।
লবণ উৎপাদন শুরু করেছেন উপকূলীয় পেকুয়া এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাষিরাও। কুতুবদিয়া-পেকুয়া ও বাঁশখালী তিন উপজেলায় শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ২২০ মেট্রিক টন। লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে সাগর তীরবর্তী উপকূল মহেশখালী, চকরিয়া, ঈদগাঁও, কক্সবাজার সদর এলাকাতেও।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলতি মৌসুমের পাঁচ মাসে কক্সবাজারের টেকনাফ, সদর, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, ঈদগাঁও, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ৬৯ হাজার একর জমিতে লবণ চাষ হবে। এতে এবারে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর ৬৮ হাজার ৫০৫ একর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়েছিল ২৪ লাখ ৩৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরুর পরবর্তী ৬২ বছরের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
এবার তাপমাত্রা বেশি এবং ঝড়-বৃষ্টি না হলে লবণ উৎপাদন ২৬ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা নির্ধারণ হয়েছে ২৫ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে কুতুবদিয়ায় ৭ হাজার একর, টেকনাফে ৪ হাজার ৪২১ একর, মহেশখালীতে ১৫ হাজার একর, পেকুয়ায় ১০ হাজার একর, চকরিয়ায় ১১ হাজার একর, ঈদগাঁওর পোকখালীতে ৫ হাজার একর, কক্সবাজার সদরে ৩ হাজার ৯০০ একর এবং বাঁশখালীতে ৭ হাজার একর ও পটিয়াতে এক হাজার ৮৫০ একর মাঠে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি চলছে।
বিসিকের তথ্যমতে, গত বছর ৬৮ হাজার একরের বেশি জমিতে আধুনিক পলিথিন পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়েছে। এবারও শতভাগ জমিতে পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদিত হবে। এ বিষয়ে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন প্রযুক্তিতে লবণ উৎপাদন আড়াইগুণ বেশি হয়। জেলার ৪৪ হাজার প্রান্তিক চাষি, একলাখ শ্রমিকসহ অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন-বিপণন-পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, মৌসুম শুরুর আগেই লবণ উৎপাদন হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা খুবই খুশি। কুতুবদিয়ায় চিংড়ি ঘের হয় না বলে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মের আগেই ৭০ শতাংশ জমিতে লবণ চাষ ও উৎপাদন হচ্ছে। তেমনিভাবে বাঁশখালীর ছনুয়ায় ৫০ শতাংশ আর পেকুয়ায় ৭০ শতাংশ মাঠে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। মাঠ প্রস্তুত করছেন অন্য চাষিরাও। আগামী ডিসেম্বরের শুরু থেকে শতভাগ জমি চাষের আওতায় আসবে বলে আশা করা যায়।
তিনি আরও বলেন, আগাম চাষ শুরু হলেও এখন মাঠ পর্যায়ে লবণের দাম মিলছে মণপ্রতি ৩৪০-৩৫০ টাকা। কিন্তু একমণ লবণ উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৩৬০-৩৭০ টাকা। এখন যে দাম মিলছে তাতে খরচে ২০ টাকা ঘাটতি থাকছে। ৪০০-৪৫০ টাকা দাম পাওয়া গেলে চাষিরা লাভের মুখ দেখেন। এখন দাম কম পাচ্ছেন দেখে চাষিরা হতাশ। আর্থিক লোকসান দেখলে চাষের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এমনটি হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। দাম কেন কমলো, অনুসন্ধান করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং কালামিয়াপাড়ার লবণচাষি সোনা মিয়া (৫৩) বলেন, গত বছর ৫ একর জমিতে চাষ করে শুরু থেকে মৌসুমের শেষ পর্যন্ত প্রতিমণ লবণ বিক্রি করেছি ৪০০-৫০০ টাকায়। এ বছর ৬ একরে লবণ উৎপাদন শুরু করেছি। কিন্তু যাত্রাকালে লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৩০-৩৫০ টাকা মণে। এতে লোকসালে হাতাশায় ভুগছি। প্রতিমণ লবণ উৎপাদনে চাষিদের খরচ পড়ছে প্রায় ৩৬০-৩৭০ টাকা।
কক্সবাজারের ঈদগাঁওয়ের পোকখালীর লবণচাষি সাইফউদ্দিন ও রিদুয়ানুল হক বলেন, পোকখালীর লবণমাঠ সমৃদ্ধ ঘেরগুলো বর্ষায় চিংড়ি চাষে ব্যবহার হয়। নভেম্বরের শেষ সময় পর্যন্ত ঘের চলমান থাকে। তবে মাঝামাঝি সময়ে মাঠ শুকিয়ে খালে পানি রাখা হয়। গোমাতলী-পোকখালী, মহেশখালী, চকরিয়াসহ আরও কিছু এলাকায় এখনো ঘের বিদ্যমান। তবে সদরের চৌফলদন্ডী, খুরুশকুল, ভারুয়াখালী ও ঈদগাঁওর পোকখালী-গোমাতলীতে মাঠ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু দাম কম শুনে অনেকে চাষে নামবে কি না দোলাচলে রয়েছেন।
লেমশীখালীর আমজাদ হোসেন ছোটন বলেন, গত কয়েক বছর লবণে টানা দাম পাওয়ায় মনে হচ্ছে সিন্ডিকেট করে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে চাষিদের লবণ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করছে। এতে লক্ষ্য পূরণ না হলে, লবণসংকট দেখিয়ে বিদেশ থেকে আমদানি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে হয়তো। লোকসানে লবণ বিক্রি হচ্ছে দেখে বহুচাষি জমির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। তাতে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বিসিক কক্সবাজার লবণ শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের ডিজিএম জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুম শুরুর ১৫ দিন আগেই মাঠে নেমেছে লবণচাষিরা। কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও বাঁশখালীতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে দেখে আমরা আশান্বিত। এবারও মৌসুম শেষ হবে রেকর্ড উৎপাদনে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে পুরো জমিতে লবণ উৎপাদন হয়ে চলবে টানা পাঁচ মাস। মৌসুমে দৈনিক ৪৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল গত বছর মার্চে। তবে একবার বৃষ্টি হলে টানা পাঁচ থেকে সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে। চাষিরা যেন ন্যায্যমূল্য পান, সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
এফএ/জেআইএম