আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন ঘিরে বিএনপির রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। মিত্র দলগুলোর কিছু নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও পেশাজীবীরা ‘সম্ভাব্য প্রার্থী’ হিসেবে আলোচনায় আসায় আসনভিত্তিক নেতৃত্ব নিয়ে দলের ভেতরেই তৈরি হয়েছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
দীর্ঘদিন মাঠে থেকে সংগঠন ধরে রাখা স্থানীয় নেতাদের অভিযোগ, এলাকার বাইরের প্রার্থী ও মিত্র দলের প্রতিনিধিদের অগ্রাধিকার দিয়ে তৃণমূল নেতাদের উপেক্ষা করা হচ্ছে। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, এর পেছনে কাজ করছে দলে প্রভাব বিস্তার ও গ্রুপভিত্তিক তদবিরের রাজনীতি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে থানা বিএনপির একজন নেতা জাগো নিউজকে বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আমরা এখানে সংগঠন টিকিয়ে রেখেছি। এখন বাইরে থেকে কেউ এসে নেতৃত্ব নেবে—এটা মেনে নেওয়া কঠিন।’
আরেকজন নেতা বলেন, ‘মাঠের বাস্তবতা না বুঝে প্রার্থী নির্ধারণ করা হলে তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া সামলানো কঠিন হবে।’
‘বিএনপির পক্ষ থেকে ববি হাজ্জাজের জন্য কাজ করার কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।’— বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম
তবে কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, এখনো কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপির এক স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেন, ‘দলীয় স্বার্থই আমাদের মুখ্য বিষয়। মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা চলছে, তবে তৃণমূলকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।’
বিভিন্ন আসনে অস্বস্তি
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকার অন্তত দশটি আসনসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় মিত্র দল বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য প্রার্থী করা নিয়ে আলোচনা চলছে।
ঢাকা–১৩ আসনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম দীর্ঘদিন ধরে সংগঠন টিকিয়ে রেখেছেন। তবে সম্প্রতি মহানগর উত্তর বিএনপির সভাপতি আমিনুল হক সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজকে পরিচয় করানোর পর স্থানীয় নেতাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে তারেক রহমানের মতবিনিময়
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি, গুলশানে নেতাকর্মীদের জটলা
বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিতে হেভিওয়েট প্রার্থী, লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি
দলীয় বিবেচনা নয়, যোগ্য-জনবান্ধব প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হবে
মোহাম্মদপুর থানা বিএনপির সদস্য আলমগীর হোসেন লাবু বলেন, ‘১৩ বছর ধরে আমরা আবদুস সালামের নেতৃত্বে কাজ করছি। এখন বাইরে থেকে কাউকে আনা হলে তা কর্মীদের জন্য অন্যায্য হবে।’
৩৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফয়সাল ভুঁইয়া সোহেল বলেন, ‘দলের বাইরে কাউকে প্রার্থী করা হলে তৃণমূল হতাশ হবে, ভোটাররাও মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে।’
দল যদি রাশেদকে মনোনয়ন দেয়, এ আসন হারাবে। রাশেদ এখানে সক্রিয় নন। তার তেমন কোনো স্থানীয় সমর্থকও নেই।- ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল মজিদ
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে ববি হাজ্জাজের জন্য কাজ করার কোনো নির্দেশনা এখনো পাইনি। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দল যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই চূড়ান্ত।’
ঢাকার বিভিন্ন আসনে বিএনপি-মিত্রদের সম্ভাব্যপ্রার্থী তালিকা
ঢাকা–৬: বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ইশরাক হোসেন ও মহানগর দক্ষিণের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশারের পাশাপাশি গণফোরামের সুব্রত চৌধুরীর নাম আলোচনায়।
ঢাকা–৭: বিএনপির মীর নেওয়াজ আলী, হামিদুর রহমান হামিদ ও যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকার মনোনয়নপ্রত্যাশী। মিত্র দলের প্রার্থী হিসেবে ইসলামী আন্দোলনের মামুনুল হকের নাম শোনা যাচ্ছে।
ঢাকা–৮: বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসের বিপরীতে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক আছেন আলোচনায়।
ঢাকা–১০: বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম ও নির্বাহী কমিটির সদস্য রবিউল ইসলাম রবির সঙ্গে আলোচনায় আছেন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
ঢাকা–১১: বিএনপির ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক সম্পাদক এম এ কাইয়ুমের পাশাপাশি আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
ঢাকা–১২: বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন-নবী খান সোহেল ও নির্বাহী কমিটির সদস্য সাইফুল ইসলাম নীরব। অন্যদিকে, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি ও তাসলিমা আখতার।
ঢাকা–১৪: বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এস এ সিদ্দিক সাজুর বিপরীতে মায়ের ডাক সংগঠনের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি।
কারও কোনো দাবি থাকলে জনগণের কাছে যাওয়া ভালো: আমীর খসরু
বিএনপির কমিটিতে আ’লীগের পদধারীরা, বিক্ষোভ-মশাল মিছিল
ফেসবুকে বিএনপি নেতাকে চাঁদাবাজ বলায় ৫০ কোটি টাকার মানহানি মামলা
ঢাকা–১৭: বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী কামাল জামান মোল্লার বিপরীতে মিত্র দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ।
ঢাকা–১৮: বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী এস এম জাহাঙ্গীর, জেএসডির তানিয়া রব ও নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্নাও রয়েছেন আলোচনায়।
ঢাকার বাইরের আসনেও অস্বস্তি
ঝিনাইদহ-২ সংসদীয় আসনে প্রচারণা চালাচ্ছেন বিএনপির জেলা সভাপতি আব্দুল মজিদ ও গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খাঁন।
জানতে চাইলে আসন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘দল যদি রাশেদকে মনোনয়ন দেয়, এ আসন হারাবে। রাশেদ এখানে সক্রিয় নন। তার তেমন কোনো স্থানীয় সমর্থকও নেই।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় নেতাদের মতে, রাশেদ খাঁন কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে পরিচিত হলেও ঝিনাইদহে বিএনপির সাংগঠনিক বাস্তবতা সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই। স্থানীয়রা চান— এ আসনে ‘বাইরের প্রার্থী’ নয়, স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত নেতাকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক।’
পটুয়াখালী–৩ সংসদীয় আসন নিয়ে প্রচারণায় ব্যস্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা হাসান মামুন ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর।
নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে হাসান মামুন বলেন, ‘নুরকে ছেড়ে দিলে বিএনপি এ আসন হারাবে। স্থানীয়রা বিএনপির প্রার্থী চায়, কোনো মিত্র দলের কাউকে নয়।’
তৃণমূলের নেতারা জানান, বিএনপির দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক ঘাঁটি এ আসনে নতুন মুখ এলে কর্মীদের মনোবল দুর্বল হবে। ফলে স্থানীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কাউকে মনোনয়ন দিলে দলীয় ঐক্যে ভাঙন ধরতে পারে।
সূত্র জানায়, বিএনপি অন্তত ৫০ থেকে ৭০টি আসনে মিত্রদের ছাড় দিতে পারে। তবে এসব আসনে দীর্ঘদিন কাজ করা স্থানীয় নেতারা এখন মনোনয়ন হারানোর আশঙ্কায় রয়েছেন।
ধানের শীষ ছাড়া অন্য প্রতীক নয়
বনানী থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ঈমান হোসেন নূর ইমন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যারা জেল–জুলুমের শিকার, তারা শুধু ধানের শীষে ভোট দিতে চাই। বাইরে থেকে প্রার্থী এলে মনোবল ভেঙে যাবে।’
ঢাকা-১২ আসনের বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘দল সবদিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে, আর দলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।’
ঢাকা–১৮ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী এস এম জাহাঙ্গীর বলেন, ‘দল যে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা সেটাই মেনে নেবো। তবে তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন না পেলে তাদের মন খারাপ হবে।’
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে সতর্কতা
বিএনপির অনেক নেতা মনে করছেন, অতীতে মিত্র দলের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় দল বিব্রত হয়েছিল। যেমন— মিরপুরে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ধানের শীষে ৬১ হাজার ভোট পান। গণফোরামের সুলতান মনসুর ও মোকাব্বির খান ধানের শীষে জয়ী হলেও পরে দল থেকে সরে যান।
তাদের মতে, ঢাকা শহরের আসনগুলো বিএনপির রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। এখানে তৃণমূলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন বা বিতর্কিত প্রার্থী আনা হলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, আওয়ামী লীগও জনপ্রিয়তার চেয়ে তারকা, আমলা বা বাইরের লোক দিয়ে এমপি বানিয়ে ভুগেছে। বিএনপির সেই ভুল না করা উচিত।
তৃণমূলের মতে, মিত্রদের সমন্বয় অবশ্যই জরুরি, তবে স্থানীয় বাস্তবতা উপেক্ষা করলে ঐক্যের এ কৌশলই উল্টো অস্বস্তির ফাঁদে পরিণত হতে পারে।
নভেম্বরেই সিদ্ধান্ত
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নভেম্বর মাসের মধ্যেই ২০০ আসনে এককপ্রার্থীকে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেওয়া হবে। শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যারা মনোনয়ন পাবেন না, তাদেরও যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
কেএইচ/এমএএইচ/এএসএ/এমএফএ/জেআইএম

10 hours ago
6








English (US) ·