পাটের ব্যাগ তৈরি করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন আসমা আক্তার। তার তৈরি পাটের ব্যাগের সুনাম ছড়িয়েছে বিদেশেও। প্রথমবারের মতো এক লাখ পিস পাটের ব্যাগ যাচ্ছে ওমানে। আসমার তৈরি ব্যাগ শরীয়তপুরের সীমানা ছাড়িয়ে রাজধানীতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ ব্যাগ তৈরির মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে অনেক নারী।
আসমা আক্তারের বাড়ি শরীয়তপুর সদর উপজেলার ডোমসার ইউনিয়নের কোয়ারপুর গ্রাম। তার বাবার নাম মৃত লাল মিয়া হাওলাদার ও মা জোবেদা বেগম। জন্ম থেকে মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা ও পায়ে কিছুটা সমস্যা থাকায় দাঁড়াতে পারেন না তিনি। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পরিশ্রম আর মেধা দিয়ে হয়েছেন সফল নারী উদ্যোক্তা। সব সময় চাইতেন নিজে আত্মনির্ভরশীল হবেন এবং অন্য বেকার নারীদেরও আত্মনির্ভরশীল বানাবেন। তাই ব্লক বাটিকের কাজ শিখে শহরের পালং বাজারের সৌদিয়ান সুপার মার্কেটের অপর পাশে ছোট একটি দোকান দিয়ে নিজের আয়ের পথ খুঁজে নেন তিনি। অন্যান্য কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও নারীদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার এ অদম্য ইচ্ছে শক্তি আর কাজের মাধ্যমে ২০২২ সালে যুব পুরস্কার ও জেলা পর্যায় হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা।
আসমা আক্তার সব সময় তার এ ছোট্ট শহর শরীয়তপুরকে নিয়ে ভীষণ ভাবতেন। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পলিথিন দেখে তার ভীষণ কষ্ট হয়। তাই পলিথিনের দূষণের হাত থেকে পরিবেশ রক্ষায় পাটের ব্যাগ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে অল্প পরিসরে পাটের ব্যাগ তৈরি করা শুরু করেন তিনি। এরপর সাড়া পেলে ধীরে ধীরে আরও সব দৃষ্টিনন্দন ব্যাগ প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেন। তার এ ছোট্ট কারখানা ও ব্যাগ তৈরির সঙ্গে যুক্ত থেকে ২৫ থেকে ৩০ জন নারীর কর্মসংস্থান হয়েছেন। পাশাপাশি তার এ কারখানায় তৈরি হচ্ছে ২৫ রকমের ব্যাগ।
ওমানের একটি শপিংমল থেকে ১ লাখ পিচ ব্যাগের অর্ডার পেয়েছি। ইতোমধ্যে আমি তাদের বেশ কিছু ব্যাগ পাঠিয়েছি। ধীরে ধীরে ব্যাগগুলো ওমানে চলে যাবে। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে আমার জেলা এবং আশপাশের জেলায় পলিথিনের পরিবর্তে এ পাটের ব্যাগ ছড়িয়ে দিবো।’
বর্তমানে তার উৎপাদিত এক লাখ পিস ব্যাগ আরবের দেশ ওমানের একটি শপিংমলে যাচ্ছে। তবে আর্থিক সংকটের কারণে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ছেন এই নারী। সরকারিভাবে স্থান ও সুদ মুক্ত ঋণের দাবি তার।
- আরও পড়ুন
বাংলাদেশ থেকে পাটপণ্য আমদানিতে আগ্রহী আলজেরিয়া - জীবন মানেই দৌড়, থামলেই আয় বন্ধ
- পাটের শপিং ব্যাগ ভর্তুকিমূল্যে সরবরাহ করা হবে: রিজওয়ানা হাসান
- চাকরি ছেড়ে এখন সফল উদ্যোক্তা স্মৃতি রায়
আসমা আক্তার বলেন, ‘আমার জেলায় পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পলিথিনের বিকল্প হিসেবে এমন কী তৈরি করা যায়। যা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যাবে এবং তা পরিবেশ বান্ধব হবে। পরে আমি পাটের ব্যাগ তৈরির সিদ্ধান্ত নেই। পাটের ব্যাগ তৈরির পর-পর অনেক সাড়া পাই। পরে আমি আমার এ ব্যাগ তৈরি আরও বাড়িয়ে দেই। বর্তমানে আমার এখানে ২৫ ধরনের পাটের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। যা থেকে অনেক বেকার নারী ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সবচাইতে আনন্দের বিষয়, ওমানের একটি শপিংমল থেকে ১ লাখ পিচ ব্যাগের অর্ডার পেয়েছি। ইতোমধ্যে আমি তাদের বেশ কিছু ব্যাগ পাঠিয়েছি। ধীরে ধীরে ব্যাগগুলো ওমানে চলে যাবে। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা রয়েছে আমার জেলা এবং আশপাশের জেলায় পলিথিনের পরিবর্তে এ পাটের ব্যাগ ছড়িয়ে দিবো। এতে আমাদের পরিবেশ পলিথিনের দূষণ থেকে মুক্ত হবে। তবে আমার আর্থিক ও স্থান সংকটের কারণে সেভাবে বেশি ব্যাগ তৈরি করতে পারছি না। সরকার যদি আমাকে সহযোগিতা করে আশা করছি আমি আরও এগিয়ে যেতে পারবো।’
‘ব্লক বাটিকের কাজ শিখে শহরের পালং বাজারের সৌদিয়ান সুপার মার্কেটের অপর পাশে ছোট একটি দোকান দিয়ে নিজের আয়ের পথ খুঁজে নেন তিনি। অন্যান্য কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী ও নারীদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। এরপর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার এ অদম্য ইচ্ছে শক্তি আর কাজের মাধ্যমে ২০২২ সালে যুব পুরস্কার ও জেলা পর্যায় হয়েছেন শ্রেষ্ঠ জয়িতা।’
আসমা আক্তারের এ পাটের ব্যাগ তৈরির কারখানায় কাজ করে শহরের প্রেমতলা এলাকার গৃহবধূ জুঁই আক্তার। স্বামী ও পরিবারের পাশে দাঁড়াতে আসমা আক্তারের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন ব্যাগ তৈরি করে নিজেই আয় করছেন।
জুঁই আক্তার বলেন, ‘আমি সংসারের কাজের পাশাপাশি পাটের ব্যাগ সেলাই। কাজের ফাঁকে ফাঁকে দিনে পাঁচটি ব্যাগ সেলাই করতে পারি। কাজ না থাকলে ২০ থেকে ২৫ টি পর্যন্ত সেলাতে পারি। একাজ করে আমি আমার স্বামী-সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। নিজের হাত খরচ নিজে চালাতে পারি।’
মাদারীপুরের কালকিনির খাসেরহাট থেকে এ ব্যাগ তৈরির কাজ করতে এসেছেন স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সোনিয়া আক্তার। মূলত কলেজের ক্লাস শেষে তিনি এখানে বাকি সময়টুকু কাজ করে থাকেন। সোনিয়া বলেন, ‘আমরা এখানে ২৫ ধরনের পাটের ব্যাগ তৈরি করে থাকি। যা বাজার থেকে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীও এ ব্যাগ ব্যবহার করতে পারে। আমাদের তৈরি ব্যাগ এখন বিদেশে যাচ্ছে যা আমাদের জন্য আনন্দের। আমরা আশা রাখি ভবিষ্যতে পলিথিনের ব্যবহার কমাতে পাটের ব্যাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
‘পাটের ব্যাগ তৈরির পর-পর অনেক সাড়া পাই। পরে আমি আমার এ ব্যাগ তৈরি আরও বাড়িয়ে দেই। বর্তমানে আমার এখানে ২৫ ধরনের পাটের ব্যাগ তৈরি হচ্ছে। যা থেকে অনেক বেকার নারী ও কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।’
পলিথিনের বিকল্প হিসেবে তার এ পাট পণ্য উৎপাদনকে সাধুবাদ জানিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রাসেল নোমান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘শরীয়তপুরের এক নারীর উদ্যোক্তা পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্য উৎপাদন করছেন। এটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই। তাছাড়া পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পরিবেশবান্ধব পাটের ব্যাগগুলো টেকসই এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারের উপযোগী। এটি আরও সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য হওয়া প্রয়োজন। আমরা সব সময় তার পাশে আছি এবং অবৈধ পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যাবো।’
এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইলোরা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসমা আক্তারের উৎপাদিত ব্যাগগুলো প্লাস্টিক ব্যাগের পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে। তার তৈরি পণ্য এ ব্যাগগুলো এখন দেশের বাহিরেও যাচ্ছে যা আমরা অবগত আছি। আমরা এ ধরনের নারী উদ্যোক্তাকে সব সময় সাধুবাদ জানাই। আমরা তাদের উন্নয়নে কাজ করে যাবো এবং তারা যদি সরকারিভাবে কোনো ঋণের জন্য আবেদন করেন, আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিবো।
আরএইচ/জেআইএম