আহারে সাদা পাথর! কত লোভী, মূর্খ আমরা

4 hours ago 4

সিলেটের সাদা পাথর শুধু একখণ্ড প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয় বরং এই সম্পদকে ঘিরে গড়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের জীবিকা, পর্যটনের সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যের প্রতীকী রূপ। অথচ এই সম্পদ দিনের আলোয় প্রকাশ্যে চুরি হয়ে গেছে, লুটপাট চলেছে নির্লজ্জভাবে। পরিবেশ বিধ্বংসী সাদা পাথর লুটের ঘটনা আমাদের প্রশাসনিক মূর্খতা ও স্থানীয় রাজনৈতিক শূন্য নৈতিকতার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত।

সিলেটের সাদা পাথর এক অনন্য সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্যের আধার। এটা আমাদের একটি জাতীয় সম্পদ। এই প্রাকৃতিক ভান্ডারকে রক্ষা করা ছিল আমাদের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। অথচ সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ্যে ঘটে যাওয়া সাদা পাথর লুট প্রমাণ করেছে আমরা কেবল দায়িত্বহীন নই, বরং পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডে মূর্খতার চরম নজিরও স্থাপন করেছি। সংবাদে শিরোনাম হয়ে এসেছে স্থানীয় প্রশাসনের রহস্যজনক উদাসীনতায় স্থানীয় নেতা, লোভী কিছু মানুষের ঐকমত্যে সাদা পাথর লুটের মচ্ছব চালানো হয়েছে।

তবে কিছু সাদামনের স্থানীয় মানুষ বলেছেন, আহারে সাদা পাথর! তোদের কপালেও চুরি-হাইজ্যাকের থাবা বসলো। চুরি হওয়া সাদা পাথর চোরেরা লুকিয়ে ফেলেছে। কেউ মাটিতে পুঁতে রেখেছে, কেউ বা পুকুরে ডুবিয়ে রেখেছে! পরিবেশ উপদেষ্টা দেখে যাওয়ার দশদিন পর এখন সেগুলো উদ্ধার করার তৎপরতা চলছে। আবার ভোলাগঞ্জের সেই স্থানে পাথর প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু উদ্ধার করা নোংরা হওয়া ভিন্ন রঙের ম্লান পাথর আগের সাদা পাথরের মতো আর চক্ চক্ করছে না। কাকচক্ষুর মতো টলটলে পানির পাশে সাদা পাথরের ওপর ক্যামেরার ঝিলিক আসছে না। এসব দেখে পর্যটকরা ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। তারা বলছেন কত লোভী, মূর্খ আমরা সবাই!

তবে চারদিকে এ ঘটনার বিশ্লেষণ হচ্ছে নানাভাবে। প্রথমত, সাদা পাথরের লুট কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া অপরাধ নয়। এটি পরিকল্পিত, সংগঠিত ও দীর্ঘদিন ধরে চলমান এক প্রক্রিয়া। প্রশাসনের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে প্রশ্নবিদ্ধ। অবৈধ উত্তোলনের সরঞ্জাম, শত শত ট্রাক, ডাম্পার, আর হাজার হাজার শ্রমিকের আনাগোনা গোপন ছিল না। এটি রাতের অন্ধকারে কোনো ক্ষুদ্র চুরি নয়; দিনের আলোয় প্রকট এক লুটপাট। প্রশ্ন হচ্ছে, এ সবকিছু চোখে না পড়ার মতো ছিল? নাকি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন? হয়তো কারও আশীর্বাদ, কারও আর্থিক স্বার্থ বা কারও রাজনৈতিক আনুগত্য এই নীরবতার আড়ালে কাজ করেছে।

এটি কেবল একটি প্রাকৃতিক সম্পদের লুট নয় বরং সার্বিক নৈতিকতার সংকটের প্রতিচ্ছবি। প্রশাসন যদি আইন মানতে অনাগ্রহী হয়, সততার ভিত্তি হারায়, তবে জনগণের কাছে রাষ্ট্র কতটা গ্রহণযোগ্য থাকে? সাদা পাথর লুটের ঘটনা তাই আমাদের সামনে কেবল পরিবেশ ধ্বংসের করুণ চিত্রই হাজির করেনি, হাজির করেছে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নৈতিক দেউলিয়াত্বেরও নগ্ন প্রমাণ।

দ্বিতীয়ত, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা আরও লজ্জাজনক। যাদের জনগণের প্রতিনিধি হয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনস্বার্থ রক্ষার কথা, তারাই এখানে নীরব দর্শক। বরং অভিযোগ আছে, অনেক নেতা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই লুট থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়েছেন। তাদের নীরবতা কিংবা মদত না থাকলে এত বড় মাত্রায় সাদা পাথরের অবাধ লুটপাট সম্ভব হতো না। রাজনীতি যখন জনগণের সেবার পরিবর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন এ ধরনের নৈতিক শূন্যতা অবধারিত। জনগণের প্রতিনিধি হয়ে তারা জনগণের সম্পদ রক্ষার শপথ নেন, কিন্তু বাস্তবে তাদের কেউ কেউ লুটের অংশীদার, কেউবা প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষক। নির্বাচনের সময় জনকল্যাণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া এই নেতারা সাদা পাথর লুটের ঘটনায় ছিলেন নিশ্চুপ। বরং নীরব সমর্থন দিয়েই তারা প্রমাণ করেছেন যে, জনগণের স্বার্থ নয়, ব্যক্তিগত লাভই তাদের রাজনীতির চালিকাশক্তি।

সাদা পাথরের লুট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ক্ষমতাধরদের নীরবতা ও স্বার্থপরতা কীভাবে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি, এবং প্রকৃত অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এজন্য একটি নির্বাচিত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায়, একদিন হয়তো আমরা শুধু ইতিহাসে পড়ব, সিলেটের ভোলাগঞ্জে একসময় সাদা পাথর নামে এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার ছিল। লুটেরারা যোগসাজশের মাধ্যমে ঐকমত্য করে দিনের আলোয় সেটার ধ্বংস সাধন করেছে।

তৃতীয়ত, আজ যখন আমরা দেখি পাহাড় ক্ষয়ে যাচ্ছে, নদী ভেঙে পড়ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এ কেবল প্রাকৃতিক ক্ষতি নয়, এটি আমাদের সমাজ ও মানুষের নৈতিক ক্ষয়। যদি প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের দায়িত্বে সৎ থাকত, তবে এত নির্বাক মানুষের সামনে সাদা পাথরের এই অমূল্য ভান্ডার এভাবে ক্ষতবিক্ষত হতো না। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহতা নিয়ে আমরা মুখে মুখে আলোচনা করি, কিন্তু বাস্তবে নিজেরাই পরিবেশ ধ্বংসে অংশ নিই। এটা নিছক অবহেলা নয়। এটা আমাদের সামষ্টিক অজ্ঞতা ও মূর্খতারই প্রমাণ।

এ ঘটনা আমাদের সমাজের মূর্খতাকেও নগ্নভাবে উন্মোচন করেছে। আমরা হয়তো কিছু টাকার লোভে মুহূর্তের জন্য পাহাড় কেটে ফেলতে পারি, নদী শুষে নিতে পারি, কিন্তু এতে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের পরিবেশ, কৃষি, জীববৈচিত্র্য এবং মানবজীবন ধ্বংস হয়। এজন্য এলাকার পরিবেশবাদী যুব-তরুণদেরও কি কোনো বিকার নেই?

এখন জরুরি হলো দায়ী ব্যক্তিদের সঠিক তদন্ত ও জবাবদিহির আওতায় আনা। জনগণের সম্পদ রক্ষায় স্বচ্ছতা ও সততার ভিত্তিতে একটি কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, এই শূন্য নৈতিকতার ধারাবাহিকতা আমাদের জাতীয় সম্পদই কেবল গ্রাস করবে না, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা রেখে যাবো এক ধ্বংসস্তূপ আর হতাশার উত্তরাধিকার।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কি এ ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেবো, নাকি স্বার্থান্ধতা ও মূর্খতার চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকব? প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি জবাবদিহির আওতায় না আসে, তবে এ ধরনের লুট ভবিষ্যতেও ঘটবে। পাথর উত্তোলনের নামে যেভাবে সীমাহীন লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, তা প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আইনকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। এই লুটের মিছিল চলার সময় এলাকার সচেতন তরুণ সমাজ ও এলাকার বাক্যবাগিশ রাজনৈতিক নেতারা কোথায় ছিলেন?

প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, নদী ও পরিবেশ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া, অবৈধ উত্তোলন বন্ধ করা। অথচ দেখা গেছে, লুটপাট চলার সময় প্রশাসন যেন অন্ধ-বধির হয়ে থেকেছে। এর ব্যাখ্যা হয় দুটি— তারা নীরব সমর্থন দিয়েছে, অথবা অক্ষমতার আড়ালে দায় এড়িয়েছে।

অন্যদিকে এলাকার নেতারা, যারা ভোটের সময় গ্রামগঞ্জে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছড়ান, তারাই এই লুটের সময় নির্বাক ছিলেন। কোথাও কোথাও অভিযোগ রয়েছে, তারা সরাসরি লাভবান হয়েছেন। স্থানীয় সন্ত্রাসী চক্র ও দখলদারদের ছত্রছায়া ছাড়া এত বড়োসড়ো লুটপাট সম্ভব নয়। একটি বড় রাজনৈতিক দল বলেছে, তারা প্রাকৃতিক সম্পদের দখলবাজি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে।

আরেকটি রাজনৈতিক দল পরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, সাদা পাথর লুটপাকারীরা তাদের দলের কেউ নয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্ণধার বলেছেন, আমরা এই গণলুটপাট নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি! তাহলে সাদাপাথর লুটপাটের জন্য ঐকমত্য কাদের সাথে কে বা কারা কারা করেছিল? পরিবেশ ধ্বংসকারী এই ঐকমত্য বা যোগসাজশ করার জন্য দায় কার? চোর চুরি করে চলে যাওয়ার পর খোর বা বেড়া দেওয়ার তৎপরতা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানসিকতায় এখনো গেঁথে আছে। সেজন্য যে কোনো অন্যায় সুবিধা নেওয়ার সময় এই জোটবদ্ধ অনৈতিক অবস্থানের নিরসন হওয়া বেশি জরুরি।

প্রশ্ন শুধু সাদা পাথর লুটের জন্য নয়, যে কোনো সম্পদবিনাশী অরাজকতা ঠেকানোর কাজটি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার সাথে জড়িত। প্রাকৃতিক সম্পদ রাষ্ট্রের, জনগণের। অথচ রাষ্ট্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ চোখ বন্ধ করে রাখে, আর রাজনৈতিক অভিভাবকরা সুযোগসন্ধানী দালালে পরিণত হয়। ফলে পরিবেশ ধ্বংস হয়, নদী হারিয়ে যায়, জীববৈচিত্র্য ভেঙে পড়ে, আর স্থানীয় জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা সবসময় আগেভাগে প্রতিরোধমূলক কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

সাদা পাথরের লুট আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, ক্ষমতাধরদের নীরবতা ও স্বার্থপরতা কীভাবে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করে দেয়। এখন প্রয়োজন স্বচ্ছ তদন্ত, দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি, এবং প্রকৃত অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এজন্য একটি নির্বাচিত শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সরকারের কোনো বিকল্প নেই। অন্যথায়, একদিন হয়তো আমরা শুধু ইতিহাসে পড়ব, সিলেটের ভোলাগঞ্জে একসময় সাদা পাথর নামে এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার ছিল। লুটেরারা যোগসাজশের মাধ্যমে ঐকমত্য করে দিনের আলোয় সেটার ধ্বংস সাধন করেছে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।
[email protected]

এইচআর/ এমএফএ/এমএস

Read Entire Article