ইনফেকশনের কারণেও অনেক শিশু অকালে জন্ম নেয়

3 hours ago 2

শিশু অনেক ধরনের স্বাস্থ্য-জটিলতা নিয়ে জন্মাতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এখন অনেক জটিলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে নিওন্যাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (এনআইসিইউ)। সেপ্টেম্বর এনআইসিইউ সচেতনতার মাস। এ সম্পর্কে জানাতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিওন্যাটোলজি (এনআইসিইউ) অ্যান্ড ইনফ্যান্ট কেয়ার বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. মো. আব্দুল মান্নান

জাগো নিউজ: এনআইসিইউ কী এবং কেন নবজাতকের জন্য এটি জরুরি?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: এনআইসিইউ বা নিওন্যাটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট হলো নবজাতকের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র। এখানে অকালে জন্মানো বা জন্মের সময় থেকেই অসুস্থ শিশুকে বিশেষ যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আগের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২৮ সপ্তাহের কম বা এক কিলোগ্রামের কম ওজনের শিশু জন্মালে সেটিকে গর্ভপাত বলে ধরে নেওয়া হতো। অর্থাৎ তখন সেই শিশুকে বাঁচানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। এখন সময় বদলেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে এই সীমা এখন ২৪ সপ্তাহে নেমে এসেছে। ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের শিশুকেও আমরা এখন বাবা-মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারি। এর সবটাই সম্ভব হয় এনআইসিইউয়ের উন্নতির কারণে।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশে অকালপ্রসূত (প্রি-ম্যাচিউর) শিশুর সংখ্যা কি আগের চেয়ে বেড়েছে?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: পরিসংখ্যান খুঁজলে হয়তো দেখবেন যে, এ হার গত ১০ বছরে দুই শতাংশের মতো বেড়েছে। কিন্তু এখানে খেয়াল করতে হবে যে, তথ্যগুলো পাওয়া যায় হাসপাতাল থেকে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করা হয় না। ফলে প্রিম্যাচিউর শিশু বা শিশুর অকাল জন্ম বেড়েছে নাকি প্রসুতি মায়েরা এখন বেশি হাসপাতালমুখী হয়েছে, এটাও দেখার বিষয়।

তবে আমার অভিজ্ঞতা বলে, মানুষ শিশুর জন্ম নিয়ে এখন আগের চেয়ে বেশি সচেতন হয়েছে, ফলে তারা হাসপাতালে আসে। চেকআপ করায়। এজন্য তথ্যগুলো সামনে আসছে বেশি। আর শিশুমৃত্যুর হার তো অবশ্যই কমেছে। আগে যে শিশুর জন্মকে গর্ভপাত বলে ধরে নেওয়া হতো, এখন আমরা তাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছি।

জাগো নিউজ: গর্ভাবস্থায় কি জানা সম্ভব যে জন্মের পর শিশুটির এনআইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হবে কি না? কোন কোন পরিস্থিতিতে নবজাতককে এনআইসিইউতে রাখতে হয়?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: অবশ্যই জানা সম্ভব। গর্ভাবস্থায় অন্তত তিনবার মায়ের আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে শিশুর বিকাশ, ওজন ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করার কথা। এই পর্যবেক্ষণের সময়ই চিকিৎসক বুঝতে পারেন যে শিশুর এনআইসিইউ প্রয়োজন কি না। অর্থাৎ, মায়ের অথবা ভ্রুণের কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা থাকলে চিকিৎসক সতর্ক করে দেন।

সাধারণত শিশু যদি অকালে জন্ম নেয়, জন্মের পর শ্বাস নিতে না পারে ও স্বাভাবিক অ্যাকটিভিটি না দেখায়, তাহলে শিশুকে এনআইসিইউতে নিতে হয়। তবে এই সিদ্ধান্ত যত দ্রুত নেওয়া হয়, শিশুর সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ততো বাড়ে। এমন পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা থাকলে কয়েক মিনিটও শিশুর মৃত্যুর বা অঙ্গহানির কারণ হতে পারে।

জাগো নিউজ: হাসপাতালে ভর্তির আগে কি সেখানে এনআইসিইউ আছে কি না সেই খোঁজ নেওয়া উচিত? কোনো হাসপাতালের এনআইসিইউ সেবা কেমন, এটা কীভাবে বোঝা যায়?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: হ্যাঁ, অবশ্যই খোঁজ নেওয়া উচিত। যদি পরিবারের কোনো গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে প্রসবের জন্য অবশ্যই এমন হাসপাতাল বেঁছে নিতে হবে, যেখানে এনআইসিইউ আছে। কারণ ডেলিভারির পর শিশুর সমস্যা দেখা দিলে দূরত্ব একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ বিষয়ে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

তবে শুধু এনআইসিইউ থাকলেই হবে না। সেটার সেবা কেমন, এটা বোঝার জন্য সেখানকার চিকিৎসকদের ব্যাপারে খোঁজ নিতে হবে। যেসব হাসপাতালের এনআইসিইউ পরিচালনার জন্য নিজস্ব চিকিৎসক দল আছে, সেখানে জরুরি সেবা পাওয়া সহজ। কারণ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র মানেই শিশু যেন ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে থাকে। খণ্ডকালীন চিকিৎসক দিয়ে তা সম্ভব না।

জাগো নিউজ: অকালপ্রসূত (প্রি-ম্যাচিউর) শিশুর জন্য এনআইসিইউ কতটা কার্যকর? এনআইসিইউতে শিশুদের কী ধরনের সেবা দেওয়া হয়?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: এনআইসিইউয়ের সেবার কয়েকটি লেভেল আছে। আমাদের দেশে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর এনআইসিইউতে লেভেল-২ পর্যন্ত সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। লেভেল-২ হলো শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে সহায়তার জন্য সিপিএপি, যাকে সিপ্যাপ বলা হয়, মেশিন, ও নন-ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর সেবা দেওয়া। জন্মের পরপর শিশুর ফুসফুস সক্রিয় না হলে এই মেশিনগুলোর সাহায্যে তাদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যবস্থা করা হয়।

লেভেল-৩ হলো রেস্পিরেটরি সাপোর্ট বা ইনভেসিভ ভেন্টিলেটর সাপোর্ট। সাধারণ মানুষের বোঝার সুবিধার্থে একে লাইফ সাপোর্ট বলা হয়। কিন্তু এটি সম্পূর্ণ লাইফ সাপোর্ট না। বড় শহরের বেশ কিছু উন্নত হাসপাতালে এই ব্যবস্থা আছে।

কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশে লেভেল-৪-এর ব্যবস্থা নেই, আমার জানা মতে। এই লেভেলে পূর্ণাঙ্গ লাইফ সাপোর্ট ও নবজাতকের সার্জারির ব্যবস্থা থাকার কথা। কিন্তু বিশেষজ্ঞ ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে আমরা এই সেবা দিতে পারি না। ফলে সার্জারির প্রয়োজন হলে আমাদের লক্ষ থাকে নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা, যাতে সে সার্জারি নিতে পারে।

জাগো নিউজ: বাড়িতে বা মিডওয়াইফের উপস্থিতিতে শিশু জন্ম নিলে কী দেখে পরিবার বুঝবে যে শিশুর এনআইসিইউ সেবা দরকার?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: বর্তমানে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসার হার বাড়লেও গ্রামের দিকে অনেকেই দাইমা অথবা মিডওয়াইফের মাধ্যমে ডেলিভারি করান। এতে কিছু জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেমন, শিশুর যদি শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা থাকে, তাহলে হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত শিশু অনেক সময় বাঁচে না। কারণ এমন পরিস্থিতিতে হাতে সময় খুব কম থাকে।

তবে কিছু লক্ষণ আছে, যেগুলো দেখে শিশুকে তাৎক্ষণিক এনআইসিইউ সেবা দিয়ে বাঁচানো সম্ভব। যেমন,
>> শিশুর স্বাভাবিক রঙ হলো গোলাপী। কিন্তু নীলচে বা কালচে রঙ মানে শিশু সুস্থ না।
>> শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি নিয়মিত না হওয়া। জন্মের পর কান্না না করা।
>> শিশু ঝিমিয়ে থাকা, নড়াচড়া না করা।
>> শিশু ঠিকঠাক সজাগ না থাকা।
>> প্রথম ২৪ ঘণ্টায় প্রস্রাব ও ৪৮ ঘণ্টায় পায়খানা না করা।
>> ঠিকমতো খেতে না পারা।
এই লক্ষণগুলো দেখলে শিশুকে তাৎক্ষণিক এনআইসিইউতে নিতে হবে।

জাগো নিউজ: শিশু এনআইসিইউতে থাকলে মা-বাবার কী ভূমিকা থাকে? এই অবস্থায় মা-বাবার পরিবার থেকে কী ধরণের সহযোগিতা প্রয়োজন হয়?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: শিশু এনআইসিইউতে থাকলে মায়ের কিছু সরাসরি ভূমিকা আছে। যেমন আগে অকালে জন্ম নেওয়া শিশুকে সরাসরি মায়ের সংস্পর্শে রাখা হতো, একে ক্যাঙ্গারু কেয়ার বলা হয়। বর্তমানে এটি আরও উন্নত হয়েছে। এখন এমএনসিইউ বা মাদার-নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটে মায়ের সঙ্গে বাচ্চাকে রাখার ব্যবস্থা আছে। এখানে মায়ের কাছে থেকে সরাসরি শিশুকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। সম্ভব হলে স্তন্যপান করানো হয়। আমাদের হাসপাতালেও এই ব্যবস্থা আছে এখন। এতে শিশুর উন্নতি দ্রুত হয়।

অন্যদিকে, এ সময় পিতারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। শিশু হাসপাতালে থাকা অবস্থায় মায়ের প্রচণ্ড মানসিক চাপ যায়। শারীরিক কিছু উপসর্গও দেখা দিতে পারে। এই বিষয়গুলোর দিকে পিতা ও পরিবারের খেয়াল রাখতে হবে।

তবে পরিবারের ভূমিকা শিশু জন্মানোর অনেক আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। একজন গর্ভবতী নারীর জন্য বাসায় অবশ্যই পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে তার পরিবারকে। কারণ মায়ের ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা সরাসরি শিশুর স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। অপরিচ্ছন্ন টয়লেট থেকে মায়ের ইউরিন ইনফেকশন হতে পারে, এর ফলে শিশু গর্ভে যে অ্যামনিওটিক থলির মধ্যে থাকে, তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমনকি শিশু পেট থেকেই ইনফেকশন নিয়ে জন্ম নেয়। ইনফেকশনের কারণেও অনেক শিশু অকালে জন্ম নেয়।

ইনফেকশনের কারণেও অনেক শিশু অকালে জন্ম নেয়

পরিচ্ছন্ন টয়লেটের অভাবে মা অনেক সময় প্রস্রাব চেপে রাখেন। এটিও শিশুর জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া সঠিক পুষ্টিকর খাবার, পরিমিত হাঁটাচলা ও নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে অনেক অকাল জন্ম প্রতিরোধ সম্ভব। এই বিষয়গুলোর দিকে পরিবারকে দৃষ্টি দিতে হবে।

জাগো নিউজ: দীর্ঘ সময় এনআইসিইউতে থাকা শিশুর ভবিষ্যতে কোনো জটিলতা দেখা দিতে পারে কি?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: হ্যাঁ, জন্মের পর দীর্ঘদিন এনআইসিইউতে থাকতে হয় যে শিশুদের, তাদের মধ্যে বিকাশগত ও পুষ্টিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেই সঙ্গে শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তিও কিছুটা ঝুঁকিতে থাকে। তবে সমস্যা বেশি না হলে চিকিৎসার মাধ্যমে তার অনেকটাই সমাধান করা যায় এখন।

জাগো নিউজ: দেশে এনআইসিইউ সেবার বর্তমান অবস্থা কেমন বলে মনে করেন? এই সেবাকে আরও কার্যকর করতে কী কী উদ্যোগ প্রয়োজন?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: দেশে এনআইসিইউ সেবার বর্তমান অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে আরও অনেক ভালো হওয়া দরকার। যেমন নবজাতক পরিবহণের জন্য কোনো বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স নেই আমাদের দেশে। ফলে শিশু জন্মের আগে মায়ের পেটে থাকতেই আমরা পরিবহণের কাজটা করতে বিশেষ গুরুত্ব দিই। কারণ জন্মের পর প্রথম দুই মাস শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এই সময় বিশেষ ব্যবস্থায় পরিবহণ না করলে তাপমাত্রার কারণে পথেই শিশুর পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দক্ষ নার্স। এনআইসিইউতে মূল সেবাটা কিন্তু নার্সই দেন। চিকিৎসক বলে দেন কী কী করতে হবে। ফলে এখানে দক্ষ জনবলের সঠিক বণ্টন খুব গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বড় বড় কর্পোরেট হাসপাতালগুলো যখন দক্ষ নার্সদের বেশি বেতন দিয়ে নিয়ে যায়, তখন আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগণ আর সেই সেবাটা পায় না।

এছাড়া আমাদের দেশে কোনো নিউবর্ন প্রোটোকল নেই। গাইডলাইন আছে। নির্দিষ্ট প্রটোকল থাকা উচিত। কোনো সেন্ট্রাল সাপোর্ট নেই, রেফারাল সিস্টেম নেই। ফলে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই নবজাতককে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দিতে অপারগ। এই বিষয়গুলোর পরিবর্তন দরকার।

জাগো নিউজ: শিশুর ওজন কম হওয়া বা শিশু এনআইসিইউতে থাকা নিয়ে সামাজিকভাবে অনেক সময় মাকে দায়ী করা হয়। এ বিষয়ে এনআইসিইউ সচেতনতা মাস উপলক্ষ্যে পাঠকদের কী বার্তা দিতে চান?
ড. মো. আব্দুল মান্নান: এ বিষয় আমি বলবো, একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনতে একজন মা যে পরিমাণ কষ্ট করেন, তা আর কেউ করেন না। ফলে মাকে দায়ী করা একটি অসুস্থ চর্চা। মায়ের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলা এখনো অনেক জায়গায় সামাজিক ট্যাবু। এসব বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ‘কারণ আপনার শিশু আপনারই ভবিষ্যৎ। আর একজন সুস্থ সন্তান সৃষ্টিকর্তার নিয়ামত। তার সুরক্ষা করা আপনারই দায়িত্ব।’

এএমপি/আরএমডি/এএসএম

Read Entire Article