ইসরায়েলের ফেরত দেওয়া ফিলিস্তিনিদের মরদেহগুলোতে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন পাওয়া গেছে। লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, ইসরায়েল থেকে ফেরত দেওয়া মরদেহগুলোর মধ্যে গলাচেপে হত্যা, গুলি করে হত্যাসহ ট্যাংকচাপায় মৃত্যুর স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে।
হামাসের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ইসরায়েল গাজায় প্রায় ৪৫ জনের অজ্ঞাত মরদেহ ফেরত দেয়।
গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালের একটি সূত্র মিডল ইস্ট আইকে জানিয়েছে, রেড ক্রসের মাধ্যমে পৌঁছানো এসব মরদেহের মধ্যে কিছু সম্প্রতি নিহত। আবার কিছু পচনধরা বা আংশিক অবস্থায় এসেছে।
একাধিক মরদেহে ভয়াবহ নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে, গলা টিপে ধরার দাগ, হাড় ভাঙা, অঙ্গহানি ও বিকৃত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কিছু মরদেহের হাত-পা ও চোখ বাঁধা ছিল। কিছু মরদেহের আবার হাত বা পা ছিলই না।
সূত্রটি আরও জানায়, কিছু মরদেহ সম্ভবত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর নিহত ফিলিস্তিনিদের, যারা ইসরায়েলি ট্যাংকচাপায় মারা গিয়েছিলেন।
ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বুধবার (১৫ অক্টোবর) আরও ৪৫টি মরদেহ ফেরত দেওয়া হয়েছে। এগুলোর ময়নাতদন্ত এখনো সম্পন্ন হয়নি।
শুক্রবার (১০ অক্টোবর) ঘোষিত যুদ্ধবিরতি ও বন্দি-বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবেই এই মরদেহ হস্তান্তর করা হচ্ছে। সোমবার (১২ অক্টোবর) হামাস ২০ জীবিত ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। এর বিনিময়ে প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে ছেড়ে দিয়েছে ইসরায়েল।
এদিকে, হামাস এখন পর্যন্ত ২৮ মৃত ইসরায়েলি বন্দির মধ্যে ৭ জনের মরদেহ ফেরত দিয়েছে, বাকি মরদেহগুলো উদ্ধার হলে ফেরত দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল এখন পর্যন্ত ৯০ ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত দিয়েছে। এই চুক্তির আওতায় মোট প্রায় ৪০০ ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত দেওয়ার কথা রয়েছে।
ইসরায়েল ১৯৪৮ সাল থেকেই ফিলিস্তিনি ও অন্যান্য আরবদের মরদেহ আটকে রাখার নীতি অনুসরণ করে আসছে। এছাড়া, যেসব ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন বা বন্দিদশায় মারা গেছেন, তাদের অনেকের মরদেহ এখনো মর্গে আটকে রাখা হয়েছে।
ইসরায়েলের কাছে মোট কতজন ফিলিস্তিনির মরদেহ রয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। তবে ফিলিস্তিনি ও আরব যুদ্ধের নিহতদের মরদেহ ফেরত চাওয়ার জাতীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ইসরায়েলের হেফাজতে অন্তত ৭৩৫ জনের মরদেহ রয়েছে, এর মধ্যে ১০ নারী ও ৬৭ শিশু। নিহতদের মধ্যে এক ১৩ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি শিশু রয়েছে, যাকে ১৯৬৮ সালে ইসরায়েলি বাহিনী হত্যা করেছিল।
এছাড়া ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র এ মাসের শুরুতে জানিয়েছিলেন, গাজায় চলমান যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বাহিনী অন্তত ২ হাজার ৪৫০ ফিলিস্তিনির মরদেহ কবর থেকে তুলে নিয়ে গেছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যে বলা হয়েছে, আরও প্রায় ১৫শ মরদেহ ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ‘সদে তেইমান’ সামরিক আটক শিবিরে রাখা হয়েছে, যেগুলোকেও শুধু সংখ্যার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা
বহু মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা অবিলম্বে সব ফিলিস্তিনি মরদেহ পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইসরায়েলি আইনে ফিলিস্তিনিদের মরদেহ আটকে রাখার অনুমতি দেওয়া আছে ও এই নীতি অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডজুড়ে প্রয়োগ করা হয়। আগে এই প্রথাটি অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হলেও, ২০১৮ সালে ইসরায়েলি সন্ত্রাসবিরোধী আইনের সংশোধনের মাধ্যমে এটি বৈধতা পায়। পরবর্তী সময়ে ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্টও এই সংশোধন বহাল রাখে।
তবে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন স্পষ্টভাবে এমন প্রথা নিষিদ্ধ করে। এতে বলা হয়েছে, মৃতদের সঙ্গে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ করতে হবে, সম্মানের সঙ্গে দাফন করতে হবে ও সম্ভব হলে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির অনুসারে।
চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ১৩০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নিহতদের কবর ‘সম্মানিত, যথাযথভাবে রক্ষিত ও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত’ হতে হবে, যাতে তা যে কোনো সময় শনাক্ত করা য়ায়।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই
এসএএইচ