ইসলামে মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য, বিভেদ, বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা করা, কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে বড় গুনাহ। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন এবং মুসলমানদের পরস্পরের ভাই হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اعۡتَصِمُوۡا بِحَبۡلِ اللّٰهِ جَمِیۡعًا وَّ لَا تَفَرَّقُوۡا ۪ وَ اذۡكُرُوۡا نِعۡمَتَ اللّٰهِ عَلَیۡكُمۡ اِذۡ كُنۡتُمۡ اَعۡدَآءً فَاَلَّفَ بَیۡنَ قُلُوۡبِكُمۡ فَاَصۡبَحۡتُمۡ بِنِعۡمَتِهٖۤ اِخۡوَانًا ۚ وَ كُنۡتُمۡ عَلٰی شَفَا حُفۡرَۃٍ مِّنَ النَّارِ فَاَنۡقَذَكُمۡ مِّنۡهَا كَذٰلِكَ یُبَیِّنُ اللّٰهُ لَكُمۡ اٰیٰتِهٖ لَعَلَّكُمۡ تَهۡتَدُوۡنَ
তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তা থেকে রক্ষা করেছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ বয়ান করেন, যাতে তোমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হও। (সুরা আলে ইমরান: ১০৩)
এ আয়াতে জাহেলি যুগে আরবদের বিভিন্ন দলের পারস্পরিক শত্রুতার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠে।
আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের পরস্পরের ভাই ঘোষণা করে কোনো দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্য হলে আপোষ-মীমাংসা করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ اِخۡوَۃٌ فَاَصۡلِحُوۡا بَیۡنَ اَخَوَیۡكُمۡ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ
নিশ্চয় মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। কাজেই তোমরা তোমাদের ভাইদের মধ্যে আপস মীমাংসা করে দাও। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, আশা করা যায় তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হবে। (সুরা হুজুরাত: ১০)
ইসলামের ঐক্যের ভিত্তি হলো তাওহিদ ও তাকওয়া অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার ওপর ইমান এবং তার যাবতীয় নির্দেশের আনুগত্যের ভিত্তিতে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোনো বিষয়ে দ্বন্দ্ব বা মতপার্থক্য হলে দেখতে হবে এ ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার বিধান বা নির্দেশ কী? আল্লাহর সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকার পর আর মতপার্থক্যের সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ لَا تَكُوۡنُوۡا كَالَّذِیۡنَ تَفَرَّقُوۡا وَ اخۡتَلَفُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ مَا جَآءَهُمُ الۡبَیِّنٰتُ وَ اُولٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
আর তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা বিভক্ত হয়েছে এবং মতবিরোধ করেছে তাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আসার পর। আর তাদের জন্যই রয়েছে কঠোর আজব। (সুরা আলে ইমরান: ১০৫)
আরেক আয়াতে আল্লাহ আআলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ اَطِیۡعُوا الرَّسُوۡلَ وَ اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡكُمۡ ۚ فَاِنۡ تَنَازَعۡتُمۡ فِیۡ شَیۡءٍ فَرُدُّوۡهُ اِلَی اللّٰهِ وَ الرَّسُوۡلِ اِنۡ كُنۡتُمۡ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ الۡیَوۡمِ الۡاٰخِرِ ذٰلِكَ خَیۡرٌ وَّ اَحۡسَنُ تَاۡوِیۡلًا
হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর অনুগত হও এবং রাসুলের অনুগত হও এবং তোমাদের মধ্যকার কর্তৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের; যদি কোনো বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটে, তাহলে সেই বিষয়কে আল্লাহ এবং রাসুলের নির্দেশের দিকে ফিরিয়ে দাও যদি তোমরা আল্লাহ এবং আখেরাত দিবসের প্রতি ইমান এনে থাক; এটাই উত্তম এবং সুন্দরতম মর্মকথা। (সুরা নিসা: ৫৯)
যেসব কাজের কারণে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হতে পারে, বিবাদ-মনোমালিন্য দেখা দিতে পারে যেমন পরস্পরকে তুচ্ছ জ্ঞান করা, বিদ্রুপ করা, খারাপ নাম বা উপাধিতে ডাকা, খারাপ ধারণা, পরনিন্দা, চোগলখুরি, অপবাদ, মানুষের পেছনে দোষ খুঁজে বেড়ানো, গোয়েন্দাগিরি করা ইত্যাদি ইসলামে অত্যন্ত কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا یَسۡخَرۡ قَوۡمٌ مِّنۡ قَوۡمٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّكُوۡنُوۡا خَیۡرًا مِّنۡهُمۡ وَ لَا نِسَآءٌ مِّنۡ نِّسَآءٍ عَسٰۤی اَنۡ یَّكُنَّ خَیۡرًا مِّنۡهُنَّ وَ لَا تَلۡمِزُوۡۤا اَنۡفُسَكُمۡ وَ لَا تَنَابَزُوۡا بِالۡاَلۡقَابِ بِئۡسَ الِاسۡمُ الۡفُسُوۡقُ بَعۡدَ الۡاِیۡمَانِ ۚ وَ مَنۡ لَّمۡ یَتُبۡ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا كَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُكُمۡ بَعۡضًا اَیُحِبُّ اَحَدُكُمۡ اَنۡ یَّاۡكُلَ لَحۡمَ اَخِیۡهِ مَیۡتًا فَكَرِهۡتُمُوۡهُ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ اِنَّ اللّٰهَ تَوَّابٌ رَّحِیۡمٌ
হে মুমিনগণ, কোনো সম্প্রদায় যেন অপর কোনো সম্প্রদায়কে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীও যেন অন্য নারীকে বিদ্রুপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রুপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ উপনামে ডেক না। ইমানের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট! আর যারা তওবা করে না, তারাই তো জালিম। হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে কি কেউ তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? তোমরা তো তা অপছন্দই করে থাক। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ অধিক তওবা কবুলকারী, অসীম দয়ালু। (সুরা হুজুরাত: ১১, ১২)
যে কোনো জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকে, কলহ-বিবাদে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে বহিঃশত্রুর সামনে দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নষ্ট হয়ে যায়। তারা শোষণ ও জুলুমের সহজ শিকারে পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَ اَطِیۡعُوا اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ لَا تَنَازَعُوۡا فَتَفۡشَلُوۡا وَ تَذۡهَبَ رِیۡحُكُمۡ وَ اصۡبِرُوۡا اِنَّ اللّٰهَ مَعَ الصّٰبِرِیۡنَ
আর তোমরা আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া করো না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন। (সুরা আনফাল: ৪৬)
সুতরাং মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার এবং বিবাদ-কলহ এড়িয়ে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। কোনো বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দিলে প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব আপস মীমাংসা করে দেওয়ার চেষ্টা করা। মুসলমানদের মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি হয় এমন যে কোনো কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
ওএফএফ/জেআইএম