মওলবি আশরাফ
খাদ্যগ্রহণ মানবজীবনের এক মৌলিক প্রয়োজন। প্রতিদিন একাধিকবার আমরা খাবার খাই। খাদ্যগ্রহণ যেমন ক্ষুধা মেটানোর জন্য অপরিহার্য, প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হিসেবে খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে উত্তম সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার অনুসরণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যা খায়, যেভাবে খায়—তা তার চরিত্র, নীতি ও রুচির পরিচয় বহন করে। তাই ইসলাম আমাদের খাওয়ার উত্তম সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার শিখিয়েছে।
১. পরিবারের সবাই মিলে খাওয়া
আল্লাহর রাসুল (সা.) পরিবারের সবাই মিলে একত্রে খেতে উৎসাহ দিয়েছেন। একসাথে বসে খেলে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়। খাবার শুধু শরীরের আহার নয়, আত্মারও প্রশান্তির কারণ হয়।
হাদিসে এসেছে, একদল সাহাবি আল্লাহর রাসুলের (সা.) কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমরা খাওয়া-দাওয়া করি, কিন্তু তৃপ্ত হই না। রাসুল (সা.) বললেন, আপনারা সম্ভবত আলাদা আলাদা খান। তারা বললেন, জী, হ্যাঁ। রাসুল (সা.) বললেন, আপনারা একসাথে খান ও আল্লাহর নাম নিন, তাহলে আপনাদের খাবারে বরকত হবে। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৭৬৪)
আরেকটা হাদিসে এসেছে, একজনের খাবার দুজনের জন্য যথেষ্ট। আর দুজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। (সহিহ মুসলিম: ২০৫৯)
অর্থাৎ একসঙ্গে খেতে দুজনের খাবারে চার জন তৃপ্তি করে খেতে পারে।
২. বিসমিল্লাহ বলে খাওয়া
খাওয়ার শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ বলা খাওয়ার অন্যতম শিষ্টাচার। এতে খাবারে বরকত আসে এবং শয়তানের অংশীদারিত্ব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে, অবশ্যই শয়তান খাবার হালাল করে নেয় (অর্থাৎ বরকত নষ্ট করে ফেলে); যদি খাওয়ার শুরুতে আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) না পড়া হয়। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৭৬৬)
৩. ডান হাতে ও নিজের দিক থেকে খাওয়া
ইসলামে যে কোনো উত্তম কাজ ডান হাতে করা উত্তম। খাওয়াও উত্তম কাজসমূহের অন্যতম। আর অনেকে একসঙ্গে খেতে বসলে সব দিকে হাত না দিয়ে নিজের সামনে থেকে খাওয়া ভদ্র ও মার্জিত আচরণ। হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) তার সৎ ছেলে ওমর ইবনে আবু সালামাকে খাওয়ার সময় বলেছেন, বৎস, আল্লাহর নাম নাও, ডান হাতে খাও, আর তোমার সামনে থেকে খাও। (সহিহ বুখারি: ৫৩৭৬)
৪. খাবারের মাঝখানে হাত না দেওয়া
এক দস্তরখানে একসঙ্গে খেতে বসলে নিজের সামনে থেকে খাওয়ই ভদ্রতা। সব দিকে হাত দিলে অন্যদের মধ্যে অরুচি তৈরি হতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, খাবারের মাঝখানে বরকত নাজিল হয়; তাই আপনারা একপাশ থেকে খান, মাঝখান থেকে খাবেন না। (সুনানে তিরমিজি: ১৮০৫)
৫. পরিমিত আহার করা
খাদ্য শরীরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য, লালসা পূরণের জন্য নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পাত্র ভর্তি করে না। যতটুকু আহার করলে মেরুদণ্ড সোজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই একজন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোনো ব্যক্তির ওপর তার নফস (প্রবৃত্তি) জয়যুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে। (সুনানে তিরমিজি: ২৩৮০)
৬. খাবারের দোষ না ধরা
খাদ্য ভালো না লাগলেই নিন্দা করা উচিত নয়। এমন কি চেহারাও বিকৃত না করা উচিত। যতটুকু ভালো লাগবে খাবে, বাকিটুকু অন্যদের জন্য রেখে দেবেন। রাসুল (সা.) কখনও কোনো খাবারের দোষ ধরেননি। ভালো লাগলে তিনি খেতেন আর খারাপ লাগলে একপাশে রেখে দিতেন। (সহিহ বুখারি: ৫৪০৯)
৭. সম্পূর্ণ খাবার খাওয়া ও পড়ে যাওয়া খাবার তুলে নেওয়া
হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) যখন খাবার খেতেন তখন তার আঙ্গুল চেটে খেতেন। এবং বলতেন, তোমাদের কারও লোকমা যদি মাটিতে পড়ে যায় তবে সে যেন ময়লা পরিষ্কার করে খাবারটুকু খেয়ে ফেলে, তা যেন শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। আর তিনি আমাদের খাওয়ার বাসন পরিস্কার করে খেতে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, আপনারা জানেন না, খাবারের কোন অংশে বরকত রয়েছে। (সহিহ মুসলিম: ২০৩৪)
৮. খাওয়ার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা
সব ভালো কাজের শেষেই আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করা ইসলামের শিক্ষা। রাসুল (সা.) খাওয়ার পর আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া আদায় করে বলতেন,
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا، وَسَقَانَا، وَجَعَلَنَا مُسْلِمِينَ
উচ্চারণ: আলহামদুলিল্লাহিল্লাযি আতআমানা ওয়া সাকানা ওয়া জাআলানা মিনাল মুসলিমিন।
অর্থ: সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের খাইয়েছেন, পান করিয়েছেন এবং মুসলিম বানিয়েছেন। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৫০)
খাবার শেষে এই শুকরিয়া মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়—রিজিক শুধু তার পরিশ্রমের নয়, বরং দয়াময় খোদার অনুগ্রহের ফল।
ওএফএফ