ঈদের মতো বড় কোনো উৎসবের জন্য মুখিয়ে থাকেন জাল নোটের কারবারিরা। অসমর্থিত একটি সূত্রের দাবি, সারা বছর তৈরি জাল নোটের প্রায় ৭০ শতাংশই বিক্রি হয় দুই ঈদ ঘিরে। ছড়িয়ে পড়ে মার্কেটে। এসময় বাড়ে চাহিদা ও দাম। চালু হয় হোম ডেলিভারি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে ব্যাপক প্রচারণা।
এবারও ঈদুল ফিতর সামনে রেখে সরব জাল টাকার কারবারিরা। তারা এতটাই বেপরোয়া যে ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে জাল টাকা বেচাকেনার প্রচারণা চালাচ্ছে প্রকাশ্যে। চার্জ নিয়ে দিচ্ছে হোম ডেলিভারি।
যেভাবে তৈরি হয় জাল নোট
নকল এ টাকা তৈরিতে ব্যবহার করা হয় টিস্যু পেপার, প্রিন্টার, ল্যাপটপ ও প্রিন্টারের কালি। পরে সফটওয়্যারের সাহায্যে মাউসে ক্লিক করলে মুহূর্তেই একের পর এক বেরিয়ে আসে ৫০০ কিংবা হাজার টাকার জাল নোট।
জাল টাকার চক্র বরাবরই ৫০০ কিংবা হাজার টাকার বড় নোট প্রিন্ট করে। কারণ এতে লাভ বেশি। কিন্তু এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে ১০ ও ২০ টাকার নোটও জাল করে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছে চক্রটি। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, বড় নোট সব ক্রেতা-বিক্রেতা দেখেশুনে যাচাই করে নেয়। কিন্তু ১০, ২০, ৫০, ১০০ কিংবা ২০০ টাকার নোট বেশি একটা যাচাই না করেই লেনদেন করেন। এতে ছোট জাল নোট খুব সহজেই বাজারে ছড়াচ্ছে।
ডলার খরচ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন
ফেসবুক, টিকটক ও ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চটকদার সব বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে জাল নোট। শুধু অর্ডার করলেই দেশের যে কোনো প্রান্তে হোম ডেলিভারির সুবিধাও রয়েছে। ২০, ৫০, ২০০, ৫০০ ও ১ হাজার টাকার নোট বেশি নকল বা জাল করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দেশে যে কোনো উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয়েছে। অব্যাহত রয়েছে অনলাইন নজরদারি। তাদের শনাক্ত করে গোয়েন্দা জালে নেওয়া হচ্ছে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে, আবার অনেকে আছে নজরদারিতে।-ডিবিপ্রধান রেজাউল মল্লিক
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ‘জাল টাকার কারখানা’ ‘জাল টাকা বিক্রি করি’, ‘জাল টাকা বিক্রি করা হয়’, ‘জাল টাকার ডিলার’, ‘জাল টাকা বিক্রি বাংলাদেশ ডট কম’, ‘ডিলার জাল টাকার’ এমন নানা নামে পেজ রয়েছে ফেসবুকে। এছাড়া টেলিগ্রামে ‘জাল টাকা’, ‘জাল টাকার লেনদেন’ ও ‘জাল টাকা সেল গ্রুপ’ নামে বিভিন্ন গ্রুপের সন্ধান মিলেছে।
- আরও পড়ুন
- সাদা কাগজ প্রিন্টারে দিলেই বের হতো জাল টাকা-রুপি
- অনলাইন-হোম ডেলিভারিতে মিলছে জাল টাকার নোট
- জাল নোট চেনার সহজ উপায়
- জাল নোট তৈরি করে বাজারে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা
‘জাল টাকার ডিলার’ নামে একটি ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, ‘আসসালামু আলাইকুম প্রিয় গ্রাহক, এই প্রথমবার আপনাদের জন্য ভালোমানের প্রিন্ট ধারা তৈরি করা নোট দিচ্ছি। সারা বাংলাদেশে হোম ডেলিভারিতে বুক করা হচ্ছে। যারা নোট নিতে ইচ্ছুক, তারা ইনবক্সে আসেন, আমাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ নোট আছে ২০, ৫০, ১০০, ২০০, ৫০০, ১০০০। সুপার কোয়ালিটি মানসম্পন্ন নোট দিচ্ছি। যারা বারবার প্রতারিত হচ্ছেন তারা লাস্ট একবার ডিল করতে পারেন। সর্বনিম্ন ২৫ হাজার টাকা। এক টাকাও অগ্রিম দিতে হবে না, শুধু ডেলিভারি চার্জ দেবেন, বুকিং দিয়ে রিসিট পাঠিয়ে দেব।’
‘জাল টাকা বিক্রি করি’ নামে একটি ফেসবুক পেজে সম্প্রতি ১০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার জাল নোট বিক্রির প্রচারণামূলক পোস্ট দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘পবিত্র ঈদ সামনে রেখে নিখুঁত ও মসৃণ প্রিন্টসহ সম্পূর্ণ এ গ্রেডের প্রোডাক্ট (জাল নোট) পাওয়া যায়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কুরিয়ার ও হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও রয়েছে।’
জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কাজ
এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দুই অভিযানে প্রায় ৮০ লাখ টাকার জাল নোটসহ ধরা পড়েছে দুটি চক্রের পাঁচ সদস্য। তবে ধরা পড়ার আগেই সম্প্রতি তারা দুই দফায় ৫০ লাখ টাকার বেশি জাল নোট বাজারে ছড়ানোর তথ্য জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। মূলত ঈদ কেন্দ্র করে ৫০ লাখ টাকার জাল নোট বাজারে ছড়িয়ে দিয়েছে এই দুটি চক্র।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জাল টাকা ছাপানোর জন্য উন্নতমানের ল্যাপটপ, প্রিন্টার, হিট মেশিন, বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিন, ডাইস, জাল টাকার নিরাপত্তা সুতা, বিভিন্ন ধরনের দামি কালি, আঠা ও স্কেল কাটার ব্যবহার করে চক্রগুলো। এছাড়া গ্রাফিক্সের কাজের জন্য চক্রে রয়েছে বেশ কয়েকজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। নিখুঁতভাবে জাল টাকা ছাপতে তাদের মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা টাকার জলছাপ থেকে শুরু করে অন্যান্য নিরাপত্তার সবই অনেকটা হুবহু নকল করছে। চক্রগুলো সারা বছর ততটা সক্রিয় না থাকলেও ঈদ ও পূজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলো টার্গেট করে জাল টাকার নোট ছাপে। টাকা ছাড়াও মার্কিন ডলার ও রুপি জাল করছে। জাল নোট তৈরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়। কিন্তু তারা জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের একই কাজ শুরু করে।
জাল টাকা ছড়িয়ে কার কত লাভ
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রতি ১০০ পিস ১ হাজার টাকার নোট অর্থাৎ এক লাখ নকল টাকা তৈরিতে খরচ পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। সেই জাল টাকা চক্রগুলো পাইকারি ক্রেতার কাছে ৮ থেকে ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। পরে পাইকারি ক্রেতা প্রথম খুচরা ক্রেতার কাছে তা বিক্রি করে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়, এরপর প্রথম খুচরা ক্রেতা দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতার কাছে আবার সেগুলো বিক্রি করে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এবং সবশেষে দ্বিতীয় খুচরা ক্রেতা মাঠপর্যায়ে দোকানে দোকানে গিয়ে বিভিন্ন নিত্যপণ্য কেনার মাধ্যমে সেসব জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে আসল এক লাখ টাকার সমপরিমাণ ভোগ করছে।
রোজা, ঈদ, পূজা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান টার্গেট করে জাল টাকার কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযানও চালানো হচ্ছে।-ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম
এক লাখ টাকার জাল নোট মিলছে ১০ হাজারে
অনুসন্ধানে দেখা যায়, এক লাখ টাকার জাল নোট পেতে সব মিলিয়ে খরচ করতে হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। তবে সেই ১০ হাজার টাকা একবারে দিতে হয় না। প্রথম ধাপে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম পাঠালেই দুদিনের মধ্যে কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয় লাখ টাকার জাল নোট। সেগুলো হাতে পাওয়ার পর বাকি টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। তবে বেশি পরিমাণে নোট অর্ডার করলে অগ্রিম টাকা কম দিলেও চলে। দুই লাখ টাকার জাল নোটের জন্য অগ্রিম পরিশোধ করতে হয় পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা।
তিন ভাগে কাজ করে কারবারিরা
জাল টাকা তৈরি থেকে শুরু করে বাজারজাত পর্যন্ত কয়েকটি ভাগে কাজ করে চক্রের সদস্যরা। প্রথমে অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি, দ্বিতীয় পর্যায়ে এ টাকাগুলো যে অর্ডার দেয় তার কাছে পৌঁছে দেওয়া এবং তৃতীয় পর্যায়ে জাল টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। বছরজুড়ে মাদকের লেনদেন, চোরাই পণ্যের কারবার, স্বর্ণ বেচাকেনাসহ বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনের সময় জাল নোট চালিয়ে দেয় চক্রের সদস্যরা। অন্য পেশায় থাকলেও বেশি লাভের আশায় অনেকে এ পেশায় জড়িয়ে পড়ছে।
যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা
জানতে চাইলে ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কামরাঙ্গীরচর থেকে জাল নোট তৈরি চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে আরও অন্তত এক ডজন কারবারির নাম। ওইসব সদস্যও রয়েছে নজরদারিতে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা হবে।’
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ডিবিপ্রধান রেজাউল মল্লিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে যে কোনো উৎসব শুরুর আগে সক্রিয় হয়ে ওঠে জাল টাকার কারবারিরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এরই মধ্যে থানা পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অভিযান শুরু হয়েছে। অব্যাহত রয়েছে অনলাইন নজরদারি। তাদের শনাক্ত করে গোয়েন্দা জালে নেওয়া হচ্ছে। অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে, আবার অনেকে আছে নজরদারিতে।’
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজা, ঈদ, পূজা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান টার্গেট করে জাল টাকার কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযানও চালানো হচ্ছে। এছাড়া সার্বক্ষণিক অনলাইন তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোতে নজরদারি করা হচ্ছে।’
টিটি/এএসএ/এএসএম