একজন খ্যাতিমান আইনজীবী। রাষ্ট্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ পদেও থেকেছেন তিনি। অথচ তার বিরুদ্ধে অভিযোগ—নিজের সাজা অন্যকে খাটানো। আইন ভাঙার এমন চাঞ্চল্যকর অভিযোগ নিয়ে বৃহস্পতিবার (০৪ সেপ্টেম্বর) বার কাউন্সিলের সামনে দাঁড়াতে হবে চট্টগ্রামের আইনজীবী মো. জুলফিকার আলী ভুট্টোকে।
জানা যায়, বার কাউন্সিলের নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগ ও জবাব নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে উপস্থাপন করা হবে। প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে বিষয়টি ট্রাইব্যুনালে যাবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনজীবীর সনদ বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ নিয়ে বুধবার (০৩ সেপ্টেম্বর) আদালতপাড়াজুড়ে ছিল আলোচনার ঝড়। একদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, অন্যদিকে ক্ষমতার অপব্যবহার—সব মিলিয়ে বৃহস্পতিবার জুলফিকার আলী ভুট্টোর ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে যাচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে—একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কীভাবে বছরের পর বছর আইনজীবীর আসনে বসে থেকেছেন?
১৯৮৭ সালের শুরু, ১৯৯০ সালের রায়
চট্টগ্রাম বন্দরের একটি চোরাচালান মামলায় ১৯৮৭ সালে গ্রেপ্তার হন জুলফিকার আলী। আদালতের নথি বলছে, তিনি প্রথমে ৭ দিন কারাগারে ছিলেন। দীর্ঘ বিচার শেষে ১৯৯০ সালের ৯ আগস্ট বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাকে ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
রায়ের পর তিনি পলাতক হয়ে যান। প্রায় এক দশক পরে আবারও নাটকীয় এক অধ্যায় শুরু হয়।
মো. এনামুল হকের মানবিক আর্তনাদ
২০০৪ সালে আদালতে হাজির করা হয় আরেকজনকে—মো. এনামুল হককে। সেই এনামুল হকই কালবেলাকে বলেন, ‘ভুট্টো আমার দুঃসম্পর্কের খালাতো ভাই। সে আমাকে আদালতে নিয়ে যায়। আমি জানতামই না তার মামলায় আমাকে হাজির করছে। পরে আদালত আমাকে জেলে পাঠায়। বিনা দোষে আমি দুই মাস হাজতে ছিলাম। বের হওয়ার পর জানতে পারি, আমি আসলে ভুট্টোর সাজা খেটেছি।’
এনামুলের কণ্ঠে ক্ষোভ ও দুঃখ মিশে যায়, ‘আমার মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে সে। আমি প্রতিকার চাই।’
কারাগারের রেকর্ডে অসঙ্গতি
চট্টগ্রাম কারাগারের প্রিজনার রেকর্ডে বন্দির নাম লেখা হয়েছিল ‘মো. জুলফিকার’। তবে শারীরিক বর্ণনায় যা লেখা হয়েছে তা জুলফিকার ভুট্টোর সঙ্গে মেলে না। রেকর্ডে উল্লেখ আছে—উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি, শ্যামলা বর্ণ, মুখের ডান পাশে ক্ষতচিহ্ন, আঙুলে তিল।
অভিযোগকারীদের দাবি, আসল জুলফিকার নন, বরং এনামুল হকই সে সময় সাজা খেটেছেন।
কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার নুরীর পাড়ার বাসিন্দা ও নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চাকরিজীবী মো. হুমায়ুন কবীর গত ১৪ জুলাই বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগ দেন। পরে ২০ আগস্ট বার কাউন্সিল ওই আইনজীবীকে নোটিশ পাঠায়। বলা হয়, আগামী ৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জবাব না দিলে বিষয়টি একতরফাভাবে (এক্স পার্টে) নিষ্পত্তি হবে।
হুমায়ুন কবীর কালবেলাকে বলেন, ‘একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামি তথ্য গোপন করে আইনজীবী হয়েছেন। পরে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মামলার দায়িত্বও নিয়েছেন। এটা ন্যায়বিচারের সঙ্গে প্রতারণা।’
আইনপেশা ও ক্ষমতার বলয়
২০০০ সালের ৯ মে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, মহানগর দায়রা জজ আদালত, ২০১৬ সালের ১৪ মে সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে নিযুক্ত হন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ছবিতে দেখা যায়, তিনি রাজনৈতিক প্রোগ্রামেও সক্রিয় ছিলেন। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের হাতে ফুল দিচ্ছেন—এমন একটি ছবিও আছে তার।
তবে কালবেলার সঙ্গে আলাপে জুলফিকার আলী ভুট্টো অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও কোনো নোটিশ পাইনি। সব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বরং অভিযোগকারীর বিরুদ্ধেই আমার কয়েকটি দেওয়ানি মামলা চলছে।’
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হাসান আলী চৌধুরী বলেন, ‘বার কাউন্সিলে অভিযোগ হলে ট্রাইব্যুনালে বিচার হয়। প্রমাণ মিললে আইনজীবীর সনদ স্থগিত বা বাতিল হতে পারে।’