পূর্বকথন:
১.১: কবিতা শুধু উপমাশ্রুত শব্দ বিন্যাসের ধাঁধা নয়, আবার গৎবাঁধা শব্দ-বাক্যের ছন্দোবদ্ধের চটুল গাঁথুনিও নয়। কবিতা এমন এক ‘বিদেহী আত্মার’ ভাষা, যেখানে হৃদয়ের গহীন হতে উঠে আসে ‘নৈশব্দের নিষ্কলুষ দ্রোহ’ কিংবা ‘প্রশান্তির মার্গীয় মাহাত্ম্য’। বোধকরি তা-ই একজন কবি তার ধাতস্থ সময়কে ভেঙে-চুরে-গলিয়ে অনাগত সময়কে সুপরিকল্পিত মর্মবাণীর সাম্রাজ্য বিনির্মাণ করেন।
১.২: এই গভীর মনস্তাত্ত্বিক আলোড়ন প্রতিটি মানুষের মাঝেই কম-বেশি তৈরি হয় বটে! কিন্তু তিনিই কবি হয়ে ওঠেন, যার প্রখর দিব্যদৃষ্টি নানান দুঃসাহসিক অভিযানের আয়োজন করেন এবং নতুনতর বাস্তবতায় বিশ্ব-ভ্রম্মাণ্ড ভ্রমণের নতুন নতুন বিলাসী আগ্রহ তৈরি করেন। এই নিরন্তর প্রক্রিয়ায় একজন কবিকে হতে হয় দুর্দান্ত সাহসী, প্রচন্ড মেধাবী ও গভীরতর প্রতিক্রিয়াশীল।
১.৩: ঐতিহাসিকভাবে তাই কবি শুধু একজন লেখকই নন বরং তিনি হয়ে ওঠেন সময় তথা কাল-পরিক্রমণের নিবেদিত রাজসাক্ষী এবং রাজনৈতিক-সামাজিক। বোধকরি, এজন্যই অগনণ মানুষের অপ্রকাশিত অনুভূতির সামষ্টিক প্রতিনিধিত্ত্বকারী কণ্ঠ এবং মনুষ্যত্ত্বের নিরন্তর ব্যাখ্যাকারী হিসেবে একজন কবি অমরত্ব লাভ করেন কিংবা সেই সক্ষমতা ধারণ করেন। এমন অমর কবিকেই আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি, তার কর্ম ও জীবনদর্শন নিয়ে আমরা অদূর ভবিষ্যৎ দেখার প্রাণান্তকর চেষ্টা করি।
১.৪: বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ হতে আধুনিক ইতিহাসে চর্চিত আলাওল, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, জীবনানন্দ হতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে অপরদিকে রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রমুখ কবিরা তাদের সময়কে ঐতিহাসিকভাবে মূল্যায়িত করে গেছেন এবং অনেক কালোত্তীর্ণ কবিতাও তাদের হাতে রচিত হয়েছে। যেখানে আর্থ-সামাজিক রীতিনীতি, প্রেম-বিরহ, আচার-অনাচার, যুদ্ধ-বিগ্রহাদি কেন্দ্র করে রচিত।
১.৫: বর্তমানের অত্যাধুনিক এই সমাজব্যবস্থায় দেশে ও বহির্বিশ্বে যারা কবিতা লিখছেন, তাদের কবিতার লিখন-কৌশল, রীতিনীতি, বিষয়বস্তু বোঝা বেশ চিন্তার বটে! যেহেতু চলমান সময়, ইতিহাস, বিষয়বস্তু নিয়ে তারা কবিতা লেখেন, সেহেতু একই সময়ে আমরা বর্তমান থেকেও তাদের বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। কারণ, কবি মানেই দূরদর্শী প্রজ্ঞার আধার এবং ভবিষ্যৎযাত্রার আলোকবর্তিকা।
কিন্তু আমাদের অতিযান্ত্রিক নির্ভরতা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপকতা এবং স্নায়ুযুদ্ধের চাইতে ভয়ংকর আধিপত্যবাদী অর্থযুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে বসবাস করতে করতে হাঁসফাঁস করেই চলছি। যেখানে বেঁচে থাকতে নিত্যদিন অসহনীয় সংগ্রাম করতে হয়, সেখানে কবি ও কবিতা নিয়ে (রসকষহীন?) আলোচনা করা চরম উপহাস আর অপব্যয় বলেই মনে করা হয়! বিষয়টা এমন যে, ‘যে করে চক্ষুদান, তারেই করি অপমান!’
১.৬: বর্তমান কবিরা যখন তাদের নির্মিত উদার ভাষাশৈলীর প্রয়োগ, মুক্ত-স্বাধীন শব্দবাক্যের বিন্যাস এবং অতীব ক্ষুদ্র হতে মহাবিশ্বের মতো বিশাল, ব্যাপক বিষয়বস্তুর খেলা খেলেন, তখন আমরা সাধারণ পাঠক মাত্রই একটু বিচলিত হই বৈকি! এদের ধ্যাণ প্রথাগত নয় বরং বহুমাত্রিক বিস্তৃত কনটেক্সটে এদের অবাধ বিচরণ।
হয়তো আগামী শত বছর পরে এই কবিগণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আদর্শিক ও সহজবোধ্য হয়ে উঠবেন এবং নতুনতর ধারা ও রীতিনীতির প্রবর্তন করবেন বলে প্রত্যাশা করি। তাদের মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা, উন্নত জীবনাধিকার চর্চা আমাদের অচলায়তন ভেঙে নতুন স্বপ্ন দেখার পথ তৈরি করে। তাই আমরা তাদের শুধু সাধুবাদ নয়, আশীর্বাদে ভরে রাখতে চাই লোক হতে লোকান্তরে, জন্ম হতে জন্মান্তরে।
কাঙ্খিত মাহাত্মলোচনার গর্ভাশয়:
পর্ব: ১
২.১: সোহেল আহসান একজন তরুণ কবি ও সাংবাদিক। পড়াশোনা-স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। তিনি স্বভাবে ও সদ্ভাবে, আচরণ ও কথাবার্তায় এবং সেন্স অব হিউমারে আস্ত একখানা কাঞ্চনজঙ্ঘা! পরতে পরতে জাতিসত্বা ও মানবিক চেতনার সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্ত্ব — একজন সোহেল আহসান।
বাঙলার মাটির সোঁদা গন্ধে যার বেড়ে উঠা, তিনি কখনও গ্রামীণ জনপদের কাঁদা মাটির ফলা, ‘একজন নুরলদীন’ আবার কখনও ইট পাথরের শহরে শিকড় সন্ধানী বোহেমিয়ান মানুষ — একজন হেলাল হাফিজ। তার কবিতার ব্যবচ্ছেদ পাঠকমহলে সমাদৃত না হলেও আফসোস নেই, কিন্তু তার কবিতার রস হৃদয়ঙ্গম করাটা সৌভাগ্যের বিষয় হবে আশা করি।
তিনি তার কবিতাসমগ্রে অখণ্ড ও নিরবিচ্ছিন্নভাবে যতটা প্রেমিক তারচেয়েও অনেক বেশি মানবিক। এই মানবিকতার বিশুদ্ধ মুসলমান সন্তান ‘সোহেল আহসান’ দেখানোর চেষ্টা করেছেন, মানবিকতার চর্চা ও শিক্ষার ক্ষেত্রে কবিতা একটি বিশেষ মাধ্যমের সাথে কীভাবে একটি অনুসন্ধানী সাহিত্যপাঠ-পরিক্রমা হয়ে ওঠে। এবং সবিশেষ বিশ্লেষণযোগ্য মুখপাত্র হিসেবে পাঠকমহলে প্রবেশ করে মানবিকতা, উদারতা, ভালোবাসার মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে উঠে।
২.২: ‘অদৃশ্য সুখের কাছে’ কবিতার বইয়ের অনেক কবিতাই আমার কাছে মসিহের খুশবুময় বাণীর মতোন! আবার অনেক কবিতাই যেন বৈরাগী সাধুর তত্ত্বকথার বাক্যবাণ! সবিশেষ, তার কবিতার ব্যবচ্ছেদযন্ত্রণা কখনও আরবীয় তলোয়ারের এক কোপের মতোন!
এতকিছু ছাপিয়ে আধুনিক শার্ট-প্যান্ট পরিহিত সোহেল আহসান একজন স্বভাবজাত সহজিয়া কবি, এ কথা হলফ করেই বলা যায়। তথাপি সোহেল আহসানের উত্থান একজন পিণ্ডদায়ক ভারতপুত্র, কিংবা কারবালার একজন ইমাম-উল শায়েরের মতোই!
২.৩: প্রিয় সোহেল আহসান, আপনি অনেক অনেক অভিবাদন ও নিরন্তর শুভেচ্ছা জানবেন। আমরা আপনার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে বুঝতে চাই, কতটা ঝোপ-ঝাড়, কাঠ-খড় এবং জঞ্জাল পেরিয়ে আমাদের হৃদয়ের কাছে আসতে চাচ্ছেন! আমরা আশাবাদী, নিরন্তর আমরা আপনাদের মতোই তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের সকল দায়িত্ব অর্পণ করতে চাই। খুঁজতে চাই সেই পথ, যে পথে আমাদেরই জন্মান্তরের অন্তর্জালে-পূর্বসুরীদের নিয়ত এবং আশীর্বাদে আপনি নেমে আসবেন আমাদের ঘর আলোকিত করে, ঘন করে বুকে জড়িয়ে ধরবেন আপনার উদার বুকের মধ্যিখানে।
২.৪: ‘অদৃশ্য সুখের কাছে’ বর্তমান বাংলা সাহিত্যে এক মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ রক্ষা করার সুপার ডাইনামিক দায়িত্ব এখন আমাদের সকল কবিতাপ্রেমীর। তাই এই ওজনদার কর্মের সাইজ মাপা যেমন জরুরি, তেমনি সাইজের ভেতর অন্তর্নিহিত তুল্য-মূল্যের বিচার করাটাও আমাদের দায়িত্ব। কারণ, পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আপনার সাথে আমাদেরও রয়েছে অসীম দায় এবং অপার্থিব মমতা।
পর্ব: ২
আমরা একটু জানতে চাই, কবিরা কেমন হয়? অথবা বিশিষ্টজনেরা কবি সম্পর্কে কী বলেছেন? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘যার মধ্যে কবিত্ব আছে, সে জগতের প্রতি গভীর ভালোবাসা অনুভব করে।’ শেলি বলেছিলেন: কবিরা সমাজের অঘোষিত আইনপ্রণেতা।
কবি কেমন হন, এই প্রশ্নের উত্তরে একটি রূপক; যেমন বলা হয়, ‘কবি হলো এক আকাশচারী পাখি, যে মাটির ধুলোতেও সৌন্দর্য খোঁজে আর নীরবতার মধ্যেও গান শোনে।’
পর্ব: ৩
সাহিত্যের তথা কবিতার একজন পাঠক-শ্রোতা হিসেবে তথাকথিত মোহ-মায়ায়, প্রেম ও বিচ্ছেদে এবং যাপিত জীবনের নানান আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত হই আমরা সবাই। তাই কবিতা কেউ বুঝতে পারে না বললে ভুল হবেই হবে! আমরা প্রথমেই দেখি ‘অদৃশ্য সুখের কাছে’ কবিতার বইখানা ছোট হলেও আমাদের প্রত্যেককেই বারবার ফিরে যেতে বাধ্য করে — আমাদের অতীত, বর্তমান এবং অনতিদূর ভবিষ্যতেও, এক অদৃশ্য সুখের কাছেই! এখানেই সোহেল আহসান একজন নির্জলা মরমী কবি হিসেবে সফল বটে।
পর্ব: ৪
যেহেতু আমাদের কর্মটা তথাকথিত ডোম পর্যায়ের, তাই এর নিরবচ্ছিন্ন পোস্টমর্টেম করাটাও আমাদের এক মহান দায়িত্ব বটে। চলুন, যথাসম্ভব ব্যবচ্ছেদ বিস্তৃত করি যেখানে কবিকে এবং কবিতা সমুহের একটি ফরমায়েশি কিন্তু প্রণিধানযোগ্য রিপোর্ট তৈরি করা যায়।
একজন সাহসী কবির তাৎপর্য:
সাহসী কবি নিজের সময়কে অতিক্রম করেন। এটি চিরন্তন ও অনিবার্য সত্য। যখন অন্যরা জেনে-বুঝেও নীরবে নিভৃতে দিনমান গুজরান করেন, তখন কবিই উচ্চারণ করেন প্রেম ও দ্রোহের বাণী। তিনি রাজদরবারে নতজানু নন, আবার জনতার করতালিরও মুখাপেক্ষী নন। তিনি সেই কণ্ঠ, যিনি সকল নীরবতার সামনে দাঁড়িয়ে যেন ‘অন্ধকারের মুখে আলোর মতো’ ছুঁড়ে দেন শব্দ-বাক্য-বাণীর চ্যালেঞ্জ!
এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আজও সেই প্রমাণ বয়ে চলছে এবং বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে, শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস যতদিন থাকবে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতিটি শব্দ আমাদের স্পন্দনে ধ্বনিত হবে, নিশ্চিত।
যদি গ্লোবালি চিন্তা করেন, তাহলে শেক্সপিয়র, বায়রন, শেলি, কিটস, নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মাহমুদ দরবিশ — তাদের কাব্য শুধু শৈল্পিক নয়, তা সামাজিক-রাজনৈতিক, নৈতিক ও অস্তিত্ববাদী সাহসের দলিল। একজন সাহসী কবি ইতিহাসকে শব্দ-বাক্যের অলঙ্কারে বাঁধেন এবং মুক্তির মন্ত্রে জাতিগোষ্ঠী তথা বিশ্বকে উজ্জীবিত করেন।
এক্ষেত্রে আমাদের সোহেল আহসান কি দুঃসাহসিক হয়ে উঠেন তার ‘মানবিকতা’ কবিতায়? যেখানে তিনি বলেন —
‘মানবিকতা চাই,
যেখানে থাকবে না চোখ রাঙানির হিংস্রতা কিংবা অপমান
মনে মনে মিলে আছে এক আসমান।’
কি সহজ, সাবলীল একজন বাঙালী মুসলমান কবির সু-মহান মুক্তির বয়ান! যা শুধু একটি নিছক আয়তনে সীমিত নয় বরং ভূ-গোলকে ঘটে যাওয়া নানান অঘটন-অপকর্ম-সংঘাত-সহিংসতার বিরুদ্ধে এক সুদৃঢ় মানবিক ভাষণ!
অতি চেনা-জানা শব্দ-ছবির কি অসাধারণ মেলবন্ধন! যেখানে ছন্দ উদার আসমানে উড়াল দেয় আর গদ্যময় দুঃসাহসিক ডানা মেলে চারপাশের বৈরী বাতাসকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উড়ে চলে পূর্ব হতে পশ্চিম এবং উত্তর হতে দক্ষিণ!
তিনি সেই সূক্ষ্ম কাজটিও সযতনে এঁকে দিয়েছেন তার প্রতিটি কবিতার শরীরে-মনে এবং আপ্লূত করেছেন বহুমাত্রিক রূপে-রসে!
৪.৩:
একজন সাধারণ পাঠকের মনে হতে পারে, এ আবার কী?
না, ভাইটি; এ এক অসামান্য অনুভূতির সামষ্টিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ যা কাব্যরসিক ব্যতীত বোঝা বড়ই দায়! মনোজগতের বিরাণভূমে নিজস্বতার প্রকাশপুর্বক জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা এক অসামান্য ভূমিকাই বটে! যেখানে আপনি ছন্দবদ্ধ চটুলতা হয়তো পাবেন না কিন্তু পরিপক্বতা, পরিমার্জনীয়তা এবং সুগভীর চিন্তা-চেতনা-মার্গীয় দর্শনের খোঁজ পাবেন লাইনে লাইনে। এই অপার্থিব পাওয়ার আনন্দ আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে, নিশ্চিতভাবেই।
৪.৪:
মেধার কৌশলী দীপ্তি
একজন মেধাবী কবি বিশ্বসাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করেন নিজের পরাণের গহীনে, স্বজ্ঞানে, স্বেচ্ছায় এবং সহজাত ভঙ্গিমায়। এখানে কবি নিজের অন্তরাত্মার দমন-পীড়নের সংঘর্ষ যাতনায় অস্থির যেমন থাকেন, তেমনি কখনও ধীর, শান্ত এবং স্বচ্ছতার খাঁটি মুন্সিয়ানায় নিবিষ্ট থাকেন নিজ কর্ম সাধনায়।
তিনি শব্দ-বাক্যের খেলা খেলেন চিরন্তন সত্যের অভিজ্ঞতা ও মানবিক দর্শনের আলোকে। কোন মডেল বা আইকনকে সামনে রেখে নয়, বরং বাঁধাধরা নিয়ম-নৈতিকতার চেয়ে নিজের ঢংয়ে, রূপে, রসে পাঠকের মনে আসক্তি আনতে তিনি যেন বদ্ধপরিকর। কারণ, তিনি জানেন, বেলা শেষে সত্য আসবেই, তখন তিনি প্রয়োজনে হেমলক হাতে তুলে নিয়ে বলতে প্রস্তুত, ঈশ্বর তুমি সবচেয়ে মহান, সবচেয়ে দয়ালু, তুমি সবাইকে রক্ষা কর।
মি. আহসান মাইকেল মধুসূদনের থিমেটিক কাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ কিংবা শামসুর রাহমানের ন্যারেটিভ ফিচার ‘স্বাধীনতা তুমি’ অথবা জীবনানন্দর উপমাশ্রিত ‘বনলতা’ অতিক্রম করে একান্তই স্বকীয় আঙ্গিকে জীবনকে ব্যাখ্যা করতেই যে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এটা সহজেই অনুমেয়।
তাই তাঁর কবিতা হয় এক ধরণের জীবন্ত পাণ্ডুলিপি, যেখানে সহজ-সরল, দেশ মাতৃকার শ্রমজীবি এবং শিক্ষিত উচ্চাভিলাষী বিরাগী তথা শিকড় সন্ধানী আপামর ইট পাথরের বাংলাদেশীদের হাসি, কান্না, প্রেম, বিদ্রোহ এবং মুক্তির মন্ত্রপাঠ একত্রিত হয়ে উচ্চারিত হয়।
সম্ভবত তিনি স্বয়ং এমন এক ন্যারেটিভ তৈরি করেন, যা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় আর মন বলে, ওহে ব্রো, দেখুন-পড়ুন-বুঝুন; তারপর নিজের সাথে বলে কয়ে স্থির করুন আপনার, আমার জন্মান্তরের স্বপ্নভঙ্গের ব্যথিত বাণীর উদাসীনতা কোথায়, কীভাবে বা কেমনতরো অভিষ্ট্য লক্ষ্য লুকিয়ে আছে?
যেমন তিনি তার অনবদ্য এক কবিতা তথা ‘কবিতার শিরোনামে’ কবিতার শেষদিকে বলেন,
‘... কখনও কখনও সেই অদৃশ্য সুখের কাছেই
পৌঁছে দেই আমার সাম্পানকে
হঠাৎ হঠাৎ ঝাপটিয়ে উঠে আসি
হেটে হেটে পায়ে পায়ে
স্মৃতির জানালা ধরে ‘
আবার জীবনানন্দের ধীর লয়ের উল্টোরথে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে বলেন,
‘এই নদীর তীরে যেন আমার মরণ হয়
তারা ভরা রাতে যেন আমার ভ্রম হয়
ভরা জলোচ্ছ্বাসেও যেন মন খারাপ না হয়
নীল আকাশে উড়ে চলা পাখিটাই যেন আমার আনন্দ হয়।’
(অদৃশ্য সুখের কাছে; কবিতা: আনন্দ)
আবার তার ‘মুখোমুখি’ কবিতায় শুনি :
‘তুমি আমি মুখোমুখি
অভিমানে কানাকানি
সুর তাল লয়ে
সমন্বয়হীনতার মাঝখান থেকে
উঠে আসি আমি
একটি নদীর তীরে হাঁটবো বলে।’
এমনতরো রোদেলা কবিতায় যদি ভিটামিন ‘ডি’ থাকে তবে তা সকলের পোহানো উচিত। এতে আমার আপনার চর্মচক্ষুর অন্তরালে যে ষষ্ঠ চক্ষু থাকে তার আলো আরও বাড়বে। সবসময়ই আপনাকে অবচেতনভাবে তাড়িয়ে বেড়াবে কথিত নিদর্শন নিয়ে যেতে। এমনকি নিয়ে যেতে পারে আসমানী কিতাবের মতো রূহের কাছাকাছি, মাগফিরাত আর মঙ্গলের দুয়ারে।
৪.৫:
সৃজনশীলতার প্রজ্ঞা
এটি কবির অন্তর্জালে প্রতি ন্যানো সেকেন্ডের পুঞ্জীভূত মার্গীয় ভাব দর্শনের অভিজ্ঞতার রূপরেখা। যেখানে সীমারেখা ভাঙার গল্প থাকে, থাকে শিল্প-সৃজনশীলতা এক ধরণের নীরব বিপ্লবের ঢেউয়ের ওঠানামা; যেখানে প্রচলিত কাঠামো ভেঙে এবং গড়ে ওঠে নতুন এক বাঁক তথা নতুন এক অনুভবের ন্যাচারাল ভাষার বদ্বীপ। এখানেই সাহস ও মেধার যোগফলে যে কবি জন্ম নেন, তার সৃজনশীলতা হয় জ্যোতিষ্কের মতোন। এখানে নুড়িপাথরের মাঝে অমূল্য রতনের দেখা মেলে। নতুন টুরিস্ট স্পটের মতো আপনাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবে তার সৌন্দর্য অবগাহনে।
সোহেল কি তা-ই বলেন,
‘আনন্দের উপাখ্যান হয়েও
কতশত দুঃখ দেখি
দেয়ালে দেয়ালে বন্দী থেকেও
নিজেকে বিশালতায় টানি।’
(অদৃশ্য সুখের কাছে; কবিতা: বিশালতা)
আহ্ কি পরম যত্নে গড়া রুবি পান্না হীরা জহরতের শিরশির হীমময় অনুভূতির আল্পনা! কি সহজ সরল কিন্তু সহিষ্ণু কাঙালের মহাজাগতিক লীলার সাবলীল স্বপ্নবিলাস!
এমন অনেক কবিতাই আছে, যা আপনার ক্ষয়িষ্ণু পরমাত্মার গোঁড়ায় ফোঁটা ফোঁটা সারে বীজে লকলকিয়ে তুলবে। সঙ্গোপন ব্যথাগুলোর আয়ুর্বেদিক ফর্মুলার প্রলেপনে, আরোগ্য করবার মহৌষধ হিসেবে, মগজে-মননে চিরন্তন করার বাসনা জাগিয়ে তুলতে পারে বৈকি!
কবিতার নামগুলো বলতেই হয়।
যেমন: পতনের শঙ্কা, অপেক্ষা, বিভক্তি, উপাখ্যান, প্রত্যাশা, আপন, কতটুকু পাই, নাই, হারানো, চেনা-জানা ইত্যাদিসহ সর্বমোট তিরিশটি কবিতা!
সবগুলো কবিতার স্তুতিগাথা না বাড়িয়ে বরং আপনাদের ধৈর্য্য, ইচ্ছেশক্তির প্রতি অগাধ বিশ্বাস রেখে এবং ব্যক্তি বিশেষের শুভ বোধের প্রতি দ্ব্যর্থহীনভাবে হাত বাড়িয়ে বলতে চাই, একজন কবিকে নয় বরং একটি নিরেট ভাবাদর্শের প্রতি আস্থা রাখবেন। অবশ্যই নিরাশার মেঘে ভিজবেন না, আলোকিত শব্দে-বাক্যে অবগাহন করুন, নিশ্চিন্তে।
পর্ব: ৫
একটি পোস্টমডার্ন ভাবনা
তিনি শুধু কাব্যরীতি নয়, ভাঙেন সময়ের একঘেয়ে ছাঁচ। কখনও তার যাত্রাবিরতি ঘটে মাটির কাছে, কখনও কংক্রিটের কাছে। কখনো তিনি শব্দের ছন্দে জলজ আগুন জ্বালান, কখনও চুপচাপ স্থির হয়ে বলেন সবচেয়ে বিস্ফোরক কথাগুলো।
তিনি প্রশ্ন তোলেন: ‘মানুষ কেন কাঁদে?’, আবার উত্তর খোঁজেন: ‘শুধু বেঁচে থাকা জীবনের সমার্থক নয়।’
যেমন তার কবিতায় দেখি —
‘... বিভক্ত হয়েছি মনে মনে
বিভক্ত হয়েছি বর্ণ গোত্রে
বিভক্ত হয়েছি দেশে দেশে
স্বার্থপরতায় বিভক্তির দেয়াল তুলেছি
শ্রেণি সংগ্রামের মত্তে।’
(বিভক্তি)
৫.১:
রাজনৈতিকায়ন
বৈশ্বিকভাবে, এমন কবির গুরুত্ব আজকের অস্থিরতা, প্রযুক্তির কৃত্রিম আবরণ, রাজনৈতিক সংঘাত ও জলবায়ু সংকটে একজন সাহসী, মেধাবী, সৃজনশীল কবি হবেন এক বিশ্বচেতনার অগ্রপথিক। তিনি কেবল জাতীয় পরিচয়ে নয়, মানবজাতির প্রতিনিধি। সোহেল আহসান সেই কীর্তিমান কাজগুলো সবে শুরু করেছেন। শেষ করে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি ও ভরসা পাঠক মাত্রই!
কেননা, তার কবিতা বিশ্বের প্রতিটি নিপীড়িত হৃদয়ের গোপন ভাষা। তার কলমে এক হয় ইউক্রেনের শিশু, গাজার মাটি, আফ্রিকান কৃষক কিংবা বাংলাদেশের হতদরিদ্র কষ্টভোগী মানুষ। তার কবিতা হয়ে ওঠে সীমানাহীন, যেখানে মানুষ শুধুই মানুষ।
আপাতদৃষ্টিতে, একজন সাহসী, মেধাবী ও সৃজনশীল কবিকে শ্রদ্ধা জানানো মানে কেবল তার সাহিত্যকর্মকে অবলীলায় স্বীকার করে নেওয়া নয়, এ এক প্রতিজ্ঞা যে, আমরা সত্য, সুন্দর ও মানবতার পক্ষে আছি। তাই সোহেল যেন সময়ের এমন এক অভিভাবক, যার কবিতা শুধু স্মরণ করার জন্য নয়, বরং জীবনের দিক নির্দেশক।
পর্ব: ৬
পৃথিবীর ও বাংলাদেশের সমসাময়িক কবিদের সাথে সোহেল আহসান:
তরুণ কবিদের দেখা হয় এমন এক সৃজনশীল শক্তি হিসেবে, যারা প্রচলিত সৌন্দর্য ও শিল্পের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে। কেননা এরা প্রায়ই নতুন ভাষা, ভিন্ন ছন্দ এবং অনন্য কাব্যরীতি ব্যবহার করে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির নতুন দিক উন্মোচন করে। এইখানে সোহেল আহসানের কবিতার গঠনরীতি, শিল্পমূল্যের ভাবনা অনেকটাই সমান্তরাল এবং অভিন্ন হয়েও স্বকীয়তার আলোয় জ্বলে ওঠেন।
৬.১: সামাজিক প্রতিরোধ
নতুন তথা উঠতি আধুনিক কবিগণ রাজনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, বৈষম্য ও মানবাধিকার ইস্যুতে সুনামি এনেছেন। গতানুগতিক ধারায় থেকেও চিন্তা ভাবনায় উত্তরাধুনিক কাঠামোকে স্বাগতম জানাচ্ছেন দৃঢ়ভাবে।
সেই হিসেবে সোহেল আহসানের কবিতার রচনাশৈলী, মুক্তগদ্যের বিন্যাসে সামাজিক ট্রান্সলেশন ও সিমেট্রিক্যাল ভাবনা শুধু জাতীয় নয় বরং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অসীম বিপর্যয় রোধে নজরদারি যেমন রাখে তেমনি জাতীয়বাদের শিকড়ের অক্ষুণ্ণতা বজায় রাখতে সম্ভব বলেই মনে করি।
৬.২: ডিজিটাল নন্দনতত্ত্ব
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, বর্তমানের সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইউটিউব বা স্পোকেন ওয়ার্ড কবিতার মাধ্যমে কবিতার নান্দনিক অভিজ্ঞতা এখন দ্রুত ও বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে আশা করবো সোহেল আহসান একাধিক ভাষায় কবিতার বইটিকে বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে সচেষ্ট থাকবেন এবং বাংলা সাহিত্যে নতুন মাইলফলক তৈরি করে প্রজন্মের আইকনিক রূপে আবির্ভাব হবেন।
৬.৩: বাংলাদেশের তরুণ কবিদের সাথে একজন সোহেল আহসান:
ইমতিয়াজ মাহমুদ, এসএম কাইয়ুম, বিভাস রায়চৌধুরী, আশিকুর রহমান, তানভীর আহমেদ, ফারজানা সুলতানা প্রমুখ তরুণ কবি সামাজিক বৈষম্য, ভাষা ও প্রেমকে কেন্দ্র করে কবিতা লিখছেন।
উপরোক্ত লেখকদের কবিতায় সামগ্রিকভাবে কেউ নিজস্ব ভাষা ও ডেইলি লাইফকে কেন্দ্র করে লিখেছেন, আবার কেউ সামাজিক রাজনৈতিক ক্রমপরিণতি-পরিবর্তন এবং ব্যক্তি সংকটের সাংঘর্ষিকতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
তবে মুখ্য ও মিলের বিষয় যে, তারা কমবেশি সবাই নাগরিক জীবন, যুবসংস্কৃতি, হতাশা, প্রবঞ্চনা, রাজনৈতিক সংহতি, বিপ্লবী চেতনার কথা বলার চেষ্টা করেছেন। তাদের সফলতা কিংবা ব্যর্থতাকে আমরা নিজ স্বার্থেই উহ্য রেখে সোহেলের কাজ নিয়ে আলাপ করবো।
সোহেল আহসান মূলত মানবিক মুল্যবোধ, পারস্পরিক সম্পর্ক, জীবনবোধের আকাঙ্ক্ষা, নিরাভরন প্রকৃতি, স্বাধীন স্বপ্ন সর্বোপরি কাঙ্খিত না পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই তার কবিতার প্রধান প্রকাশ শক্তি।
তিনি কখনও অ্যাবসার্ড কিন্তু দ্বিধান্বিত নন। তিনি কখনও অত্যাধুনিক কখনও সেকেলের। তথাপি তার কবিতার প্রকাশভঙ্গী পুরোপুরি বহুমাত্রিক রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তার অবচেতন মন আমাদের পাহারা দেয় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ পথে ঘাটে, শহরের কোলাহল ছেড়ে সবুজ ঘাসের মায়ায় আবার কখনও সরেস জলরাশির দিকে। শুধু তাই নয়, প্রেম ও দ্রোহের পথেও তাকে দেখা যায়।
এই অবাধ বিচরণ মাঝে মধ্যে একপাক্ষিক হয়তো মনে হয় তবে সেটা নিতান্ত ক্ষণিকের। বাস্তবতা বিবর্জিত মানুষগুলোকে তিনি পাশ কাটিয়ে গেলেও ফিরে তাকান, আপন মানুষের অনুভব নিয়ে। এইখানে তার মহানুভবতার পরিচয় পাই। আমরা অন্য আরেক সোহেল আহসানকে আবিস্কার করি আর আপন করে নেই, আমাদের মতোন করে।
পর্ব: ০৭
‘অদৃশ্য সুখের কাছে’ বইটির আবেদন নিরীক্ষণ:
০৭.১: সাময়িক বাস্তবতা: প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, শহুরে একাকীত্ব, অনিশ্চয়তা তার কবিতার মূল অনুষঙ্গ। তবে তার দুর্দান্ত চেষ্টা চোখে পড়ার মতোন, যেখানে একাধারে চলমান সময়ের প্রতিফলন এবং নিদারুণ অনিশ্চয়তাকে চ্যালেঞ্জ করার প্রচণ্ড ইচ্ছা কবিতাগুলো পরতে পরতে ফুটে উঠেছে।
০৭.২: স্বকীয়তার অনুসন্ধান: আত্মসংলাপ ও আত্ম নির্মানের যে ব্যকুলতা বারবার তিনি প্রকাশ করেছেন, তা অবশ্যই আজ জাতির সংকটে প্রতিটি মানুষের সামষ্টিক প্রতিনিধিত্ত্ব করে। এখানে তিনি বেশ রুচিশীল, মার্জিত ও স্বাপ্নিক বটে।
০৭.৩: সাংস্কৃতিক বলয়জনিত সংস্কার : ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাপানিজ হাইকুর সংক্ষিপ্ত ও যৌথ ভার্সনে আপনি সচেতন কিংবা অবচেতনেই পৌঁছে গেছেন। যা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, যাদু নাকি বাস্তবতা? এই দ্বৈত অভিজ্ঞতা আমাদের ভাবনাকে যেমন খণ্ডিত করে আবার অখণ্ডিত রাখতে বারবার জোরালো তাগাদা দেয় বৈকি!
শেষকথা:
উচ্চমার্গীয় কবিতার ব্যখ্যা থাকে বাজারের নোট বই কিংবা শিক্ষকের ঠোঁটে। যারা প্রচলিত এই ধারনার বিপরীতে লেখকের আবেগ অনুভূতির সাথে সরলভাবে পরিচিত হতে চান, অতঃপর কাব্যিক ঢংয়ে-রসে-রূপে আস্বাদিত হতে চান — সোহেল আহসানের মতো তরুণ কবিদের লেখার সঙ্গে তাদের পরিচিত হওয়া দরকার
লেখক: রুহুল আমিন, নাট্যশিক্ষক
আরএমডি/জিকেএস