রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) পোষ্য কোটা পুনর্বহালের ঘটনায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। দিনভর আমরণ অনশন, বিক্ষোভ, ধস্তাধস্তি ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনে উঠতে গেলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দীনের গলা চেপে ধরে সিঁড়িতে ফেলে দেন। উপ-রেজিস্ট্রার রবিউল ইসলামের দাড়ি ধরে টান দেবার ঘটনাও ঘটেছে।
শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেল ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরী ভবনের ফটকে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় ভিডিওতে এসব চিত্র ধরা পড়ে। ধস্তাধস্তিতে সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মারসহ কয়েকজন আহত হন।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার পোষ্য কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করতে থাকেন। বিকেল ৩টার দিকে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন প্রশাসনিক ভবন থেকে বের হলে তার গাড়ি আটকে ‘ভিক্ষাস্বরূপ’ টাকা-পয়সা গাড়ির ওপরে দিতে থাকেন আন্দোলনকারীরা। উপ-উপাচার্যকে ‘ভিক্ষা’ দেওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান করলে পাশে থাকা রিকশাচালক গাড়ির ওপরে পাঁচ টাকা ও ক্যাম্পাসের এক ভিক্ষুক ১০ টাকা দেন।
একপর্যায়ে গাড়ির চাবি কেড়ে নেন বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারীরা। ফলে উপ-উপাচার্য পায়ে হেঁটে বাসভবনের দিকে রওয়ানা দেন। এসময় তার বাসভবনে ঢুকতে না দিয়ে গেটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি প্রক্টর মাহবুবর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে জুবেরী ভবনের দিকে যান। শিক্ষার্থীরাও পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করেন। উপ-উপাচার্যকে জুবেরী ভবনে উঠতে না দিয়ে তাকে জাপটে ধরে আটকে রাখেন আন্দোলনকারীরা।
একপর্যায়ে সেখানে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে তুমুল ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। উপ-উপাচার্য মাঈন উদ্দীনসহ কয়েকজনকে সামনে থেকে বাধা দেন আন্দোলনকারীরা।
ভিডিওতে দেখা যায়, এসময় পাশে থাকা প্রক্টর ও শিক্ষকরা উপ-উপাচার্যকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। উভয়পক্ষের মধ্যে টানাহেঁচড়া হয়। এসময় উপ-রেজিস্ট্রার রবিউল ইসলামের দাড়ি ধরে টান দেবার ঘটনাও ঘটে। বেশ কিছুক্ষণ এই পরিস্থিতি বিরাজ করে।
কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন সিঁড়ি বেয়ে জুবেরী ভবনে উঠতে গেলে একজন শিক্ষার্থী পিছন থেকে ধাক্কা দেন ও গলা জাপটে ধরে সিঁড়িতে ফেলে দেন। তিনি উঠে আবার ওপরে যেতে উদ্যত হলে সামনে থাকা আরেক শিক্ষার্থী আবার জাপটে ধরেন। দুজন শিক্ষকের সহায়তায় ছাড়া পেয়ে জুবেরী ভবনের দ্বিতীয় তলায় উঠে পড়েন।
আরও পড়ুন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত
পূর্ণদিবস কর্মবিরতিতে রাবি শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী
রাকসু নির্বাচন নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হবে
ওইসময় আবারও উপ-রেজিস্ট্রারের দাড়ি ধরে টান দেন এক শিক্ষার্থী। তবে তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। সালাহউদ্দিন আম্মারকেও দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরেন কয়েকজন কর্মকর্তা।
কয়েক ঘণ্টা জুবেরী ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, রেজিস্ট্রারসহ অনেকে। অবশেষে রাত সোয়া ১১টার দিকে শিক্ষার্থীরা জুবেরী ভবনের সামনে থেকে তাদের অবস্থান তুলে নেন। এতে সহ-উপাচার্য মাঈন উদ্দীনসহ কয়েকজন শিক্ষক প্রায় সাত ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর মুক্তি পান।
এদিকে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলায় কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থা বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এক প্রতিবাদলিপিতে তারা বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই—আমরা নিজেরাও পোষ্য কোটারবিরোধী। কিন্তু কোনো যুক্তি, মতভেদ বা আন্দোলনের নামে শিক্ষকের গায়ে হাত তোলা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এটি আমাদের শিক্ষাঙ্গনের সামগ্রিক মর্যাদা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের জন্য কলঙ্কজনক।’
এই আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সাবেক সমন্বয়ক ও রাকসু নির্বাচনে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ জোটের জিএস পদপ্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার। তাকে ফোন করলে বারবার কেটে দেন। তবে তিনি তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেন, ‘স্যাররা আমাদের পিতৃতুল্য। স্যারদের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই। তাই কাউকে ব্যক্তিগতভাবে অ্যাটাক বা অশালীন ভাষা ব্যবহার করিনি আমরা। আমাদের ভাইদের অনশনের ২৪ ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলেও নোটিশ প্রত্যাহারে প্রশাসনের কোনো ইচ্ছা না দেখে আমাদের এ জায়গায় আসতে হয়েছে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘স্যাররা ডিসিশন ছাড়া যেন না যান, তার জন্য প্রশাসন ভবন, বাসভবনের গেট, জুবেরী ভবনের সামনে আমরা হিউম্যান চেন করে দাঁড়িয়ে যাই। ওনারা জোরপূর্বক আমাদের হাত সরিয়ে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তারপর ছত্রভঙ্গ হয়ে সবাই স্যারদের আটকাতে চেষ্টা করেন; কারো গায়ে হাত তোলার চেষ্টা করিনি। একসময় স্যার, কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দু-একজন অনেক মারমুখী আচরণ করে আমাদের হিউম্যান চেন থেকে স্যারকে ছিনিয়ে নিতে চান। তখন আবারও স্টাফরা আমাকে গলাচিপে ধরে। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে কনুই এবং হাত দিয়ে আঘাত করে। তারপর উনারা দোতলায় উঠে যান।’
এ বিষয়ে জানতে উপ-রেজিস্ট্রার রবিউল ইসলামকে কল করলে তার বড় মেয়ে রিসিভ করেন। তিনি বলেন, ‘গতকাল রাতে আব্বুকে ইসলামিয়া হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। বুকে ও পায়েসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত লেগেছে। আব্বুর পুরো শরীর ব্যথা। তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। তিনি এখন ঘুমাচ্ছেন।’
মনির হোসেন মাহিন/এসআর/জিকেএস