এক ফার্মাসিস্টে চলছে ৭০ হাজার মানুষের চিকিৎসা

1 month ago 6

• জনবল সংকটে নেই চিকিৎসা সেবা
• ৬ মাস ধরে নেই ওষুধ সরবরাহ
• সামান্য রোগেও যেতে হয় রাজশাহীতে

আসিফ আলীর (৩৫) কাঁধে ছিল পরিবারের দায়িত্ব। গত ২ আগস্ট সাপের কামড়ে আহত হন তিনি। তার বাড়ি রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের ৫২৩ গ্রামে। এই গ্রামেই আছে এক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সাপে কামড়ানোর পর তার পরিবারের সদস্যরা জানতেন সেখানে গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাই দ্রুত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রাণ রক্ষা আর হয়নি।

আসিফের বাবা রেজাউল করিম বলেন, ঘটনার দিন বাঁশঝাড়ের পাশে আমার ছেলে শুয়ে ছিল। এসময় একটি সাপে তাকে কামড় দেয়। আমরা জানতাম ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কোনো চিকিৎসা দিতে পারে না। তাই সময় নষ্ট না করে নৌকা নিয়ে শহরে আসি। এরপর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক তাকে অক্সিজেন দেন। এর কিছুক্ষণ পরই আসিফের মৃত্যু হয়।

‘শুনেছি এখানে নাকি বিভিন্ন ওষুধ দেওয়ার কথা, তবে আজ পর্যন্ত কখনো দেয়নি। দুইদিন গেছিলাম, সেখান থেকে ঘুরে এসেছি কাউকে না পেয়ে। যদি জ্বরও হয়, নদী পার হয়ে গোদাগাড়ী যেতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, এই চরে যদি একটি ক্লিনিক থাকতো, এখানে যদি মানুষ চিকিৎসা পেতো, তাহলে আজ আমার আসিফ বেঁচে থাকতো।

আসিফের এই ঘটনা চরবাসীর প্রতিদিনের বাস্তবতা। সামান্য জ্বর, গর্ভকালীন জটিলতা কিংবা ইনফেকশন সব কিছুতেই নদী পার হয়ে রাজশাহী কিংবা গোদাগাড়ীতে যেতে হয়। এতে একদিকে যেমন সময় ও অর্থের অপচয় হয়, তেমনি ভোগান্তি পোহাতে হয় বাসিন্দাদের।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন। পদ্মা নদীর ওপারে এই ইউনিয়নে ৭০ হাজার মানুষের বসবাস। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিকিৎসা কেন্দ্র হলো ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তবে সেখানে নেই কোনো সেবা। এক ফার্মাসিস্ট দিয়েই হয় সব রোগীর চিকিৎসা। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, দ্রুত তারা একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে।

‘এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জনবল নেই। একজন মেডিকেল অফিসার, একজন ভিজিটর, একজন পিয়ন, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন নাইটগার্ডের পোস্ট আছে। কিন্তু সবগুলোই ফাঁকা। আমি শুধু ফার্মাসিস্ট হিসেবে আছি। জানুয়ারি পর্যন্ত অল্প কিছু ওষুধ ছিল। তারপর ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট কোনো ওষুধ আসেনি।’

সরেজমিনে দেখা যায়, চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই বিশাল মাঠ। সেই মাঠেই এক কোণে অবস্থিত এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি। চারপাশে আগাছা, দেওয়ালে ফাটল, ভবনের চারপাশে ঝোপ-ঝাড়। ভেতরে অন্ধকার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার চিহ্ন নেই। ভবনে প্রবেশ করতেই দেখা মিললো এক ফার্মাসিস্টের। তিনি ব্যতীত এখানে নেই ওষুধ, নেই চিকিৎসক।

স্থানীয় বাসিন্দা আয়েশা খাতুন বলেন, শুনেছি এখানে নাকি বিভিন্ন ওষুধ দেওয়ার কথা, তবে আজ পর্যন্ত কখনো দেয়নি। দুইদিন গেছিলাম, সেখান থেকে ঘুরে এসেছি কাউকে না পেয়ে। যদি জ্বরও হয়, নদী পার হয়ে গোদাগাড়ী যেতে হয়। এখানে শুধু নামেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কামে কিছুই না।

‘সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো স্থাপনা নেই। ফলে সেখানে চিকিৎসক পদায়ন ও ওষুধ দিতে পারছি না। সেখানে যেটি আছে সেটি সিডব্লিউ এর। তারা শুধু মাত্র মাতৃত্বকালীন কাজ করে।’

চর আষাড়িয়াদহের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মোমিন বলেন, এখানে চিকিৎসা না থাকায় অনেক সময় নদী পার করে নিয়ে যাওয়ার সময় গর্ভবতী মায়েরা রাস্তায় মারা যায়। আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত। শুধু একটা নামে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কোনো কার্যকর ব্যবস্থা করা হয় না। কোনো ওষুধ বা চিকিৎসা দেওয়া হয় না। যেসব ডাক্তার আছে তারা মাঝেমধ্যে আসে।

স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল্লাহীল কাফি বলেন, আমাদের ন্যায্য অধিকার যেটা চিকিৎসা, সেটা আমরা পাই না। আমাদের চরাঞ্চলের মানুষ সবসময় পিছিয়ে। শুধু একটা নদীর কারণে আমাদের এ অঞ্চলের মানুষ অন্ধকারে বসবাস করে। পড়াশোনা, চিকিৎসা সবকিছু থেকেই দূরে আছে। সরকার থেকে যে মৌলিক অধিকার পাওয়া দরকার, এ অঞ্চলের মানুষ সেগুলো পায় না। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যদি ইউনিয়নের মানুষের সেবা দিতে না পারে তাহলে কমপ্লেক্স রেখে লাভ কী? আমাদের মা-বোনদের পেটে ব্যথা হলেও রাজশাহী বা গোদাগাড়ীতে নিয়ে যেতে হয়। যেখানে আমাদের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়ার কথা, সেগুলো পাচ্ছি না।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরতদের অনুপস্থিতি ও দায়িত্বে অবহেলা প্রসঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন সদস্য জানান, দীর্ঘদিন ধরে এ সমস্যার কথা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো হলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আশরাফুল ইসলাম (ভোলা) বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো ওষুধ দেওয়া হয় না। রোগীরা শুধু ঘুরে ফিরে যায়। সমস্যাটা দীর্ঘদিনের।

স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত একমাত্র ব্যক্তি ফার্মাসিস্ট মো. রুহুল আমিন বলেন, আমাদের এখানে প্রথম সমস্যা যেটা হয় সেটা হলো স্টাফ সংকট। এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণ জনবল নেই। একজন মেডিকেল অফিসার, একজন ভিজিটর, একজন পিয়ন, একজন ফার্মাসিস্ট, একজন নাইটগার্ডের পোস্ট আছে। কিন্তু সবগুলোই ফাঁকা। আমি শুধু ফার্মাসিস্ট হিসেবে আছি। জানুয়ারি পর্যন্ত অল্প কিছু ওষুধ ছিল। তারপর ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট কোনো ওষুধ আসেনি।

তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো ওষুধ বা ডাক্তার আসে না। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কাজ ছিল, সেটাও ছয় মাস ধরে বন্ধ। মিটিংয়ে বললে বলে ওষুধ চলে আসবে। এখনো আসেনি।

এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা সিভিল সার্জন ডা. এস.আইএম রাজিউল করিম বলেন, আমরা জানি চর আষাড়িয়াদহ একটি ইউনিয়ন, সেখানে কয়েকটি গ্রাম আছে। তাদেরও দাবি আছে সেখানে একটি ক্লিনিক করা হোক। কিন্তু বাস্তবতা হলো সেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো স্থাপনা নেই। ফলে সেখানে চিকিৎসক পদায়ন ও ওষুধ দিতে পারছি না। সেখানে যেটি আছে সেটি সিডব্লিউ এর। তারা শুধু মাত্র মাতৃত্বকালীন কাজ করে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এরইমধ্যে মন্ত্রণালয়ে লিখেছি, দ্রুত সেখানে একটি স্থাপনা বানানোর জন্য। এটি হয়ে গেলে সেখানে চিকিৎসক ও ওষুধ সরবরাহ করবো।

এফএ/জিকেএস

Read Entire Article