এক বছরে খুলনায় মানুষ খুনের সেঞ্চুরি

গত ৫ আগস্টের পর থেকে খুলনা মহানগরী ও জেলায় হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে। এক সময়ের শান্ত, শিল্পনগরী হিসেবে পরচিতি খুলনা আজ রূপ নিয়েছে ভয়, আতঙ্ক আর রক্তাক্ত লাশের নগরীতে। রাতের অন্ধকার তো বটেই, এখন দিনের আলোতেও প্রকাশ্যে চালানো হচ্ছে গুলি, ধারালো অস্ত্রের কোপে ঝরছে প্রাণ। শহরের প্রতিটি অলিগলিতে ভর করছে আতঙ্ক। এ অস্বাভাবিক পরস্থিতিরি মধ্যে এগিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যেও এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা নির্বাচনী পরিবেশকেও ঘোলাটে করে তুলতে পারে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের দাবি সংশ্লিষ্ট মহলের। পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে নগরীর ৩১নং ওয়ার্ডের কমিশনারের কালভার্ট এলাকায় বাড়ির মধ্যে নানী মহিতুন্নেসা (৫৫), তার নাতি মুস্তাকিম (৮) এবং নাতনি ফাতিহাকে (৬) হত্যা করা হয়। ওই রাতেই করিমনগরে নিজ বাড়ির ভেতর আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।  গত ২৭ নভেম্বর রাতে নগরীর খালিশপুরে ইশান নামে এক যুবককে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রোববার (৩০ নভেম্বর) দুপ

এক বছরে খুলনায় মানুষ খুনের সেঞ্চুরি

গত ৫ আগস্টের পর থেকে খুলনা মহানগরী ও জেলায় হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সেঞ্চুরি ছুঁয়েছে। এক সময়ের শান্ত, শিল্পনগরী হিসেবে পরচিতি খুলনা আজ রূপ নিয়েছে ভয়, আতঙ্ক আর রক্তাক্ত লাশের নগরীতে। রাতের অন্ধকার তো বটেই, এখন দিনের আলোতেও প্রকাশ্যে চালানো হচ্ছে গুলি, ধারালো অস্ত্রের কোপে ঝরছে প্রাণ।

শহরের প্রতিটি অলিগলিতে ভর করছে আতঙ্ক। এ অস্বাভাবিক পরস্থিতিরি মধ্যে এগিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মধ্যেও এ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা নির্বাচনী পরিবেশকেও ঘোলাটে করে তুলতে পারে। এ অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের দাবি সংশ্লিষ্ট মহলের।

পুলিশের তথ্য বলছে, গত ১৬ নভেম্বর দুপুরে নগরীর ৩১নং ওয়ার্ডের কমিশনারের কালভার্ট এলাকায় বাড়ির মধ্যে নানী মহিতুন্নেসা (৫৫), তার নাতি মুস্তাকিম (৮) এবং নাতনি ফাতিহাকে (৬) হত্যা করা হয়। ওই রাতেই করিমনগরে নিজ বাড়ির ভেতর আলাউদ্দিন মৃধা নামের এক যুবককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। 

গত ২৭ নভেম্বর রাতে নগরীর খালিশপুরে ইশান নামে এক যুবককে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। রোববার (৩০ নভেম্বর) দুপুরে খুলনার মহানগর দায়রা জজ আদালত চত্বরে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয় দুইজনকে। মাদক ও আধিপত্য বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত এ দুজনই সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনের সদস্য বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। 

মঙ্গলবার (০২ নভেম্বর) সকালে ডুমুরিয়ার মিকশিমিল এলাকায় চোখ উপড়ে ফেলা অবস্থায় জীম (২৭) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। কাছাকাছি একই সময়ে চুকনগর এলাকা থেকে বেবী নামে আরও এক যুবতীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার বাসিন্দা রশিদ খন্দকারের মেয়ে বেবী খুলনায় কীভাবে আসলেন এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ক্রাইম রাশিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, মাদক বিক্রির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বেশিরভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি হত্যার পরে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ও আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছে। আসামিদেরও অনেককেই বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হলেও জামিনে বের হয়ে আবারও একই অপরাধে জড়ানোর প্রমান পাওয়া গেছে। সর্বশেষ আদালতের সামনে জোড়া খুনের আসামিরাও প্রায় সবাই শনাক্ত হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান চলছে। আশাকরি দ্রুত তাদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।

মানুষ খুনের সেঞ্চুরি 

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্য বলছে, গত ৫ আগস্ট থেকে শুরু করে খুলনা শহরে ৪৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে, যা ৫ আগস্ট পূর্ববর্তী ১ বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। এসব হত্যা মামলায় দেড়শতাধিক আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ১৬ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এসব আসামির কাছ থেকে  রাইফেল দুটি, বিদেশি রিভলভার পাঁচটি, বিদেশি পিস্তল ১৭টি, দেশি পিস্তল একটি, বন্ধুক ১টি, দুটি কাটারাইফেল, পাঁচটি পাইপগান, তিনটি শাটারগান ও তিনটি শটগান উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে খুলনা জেলায় ৪৭টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় চারজন, কুপিয়ে ও গুলি করে ২৬ জন, অজ্ঞাত কারণে ১১ জন, শ্বাসরোধ করে ২ জন এবং পরকীয়ার কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ ধারণা করছে।

এছাড়া নৗপুলিশের সামগ্রিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ বছরে খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী থেকে মোট ৫০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ পুরুষ, ৭ নারী ও ১১টি শিশু। উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে ২০ জনের পরিচয় অশনাক্ত থেকে গেছে।

এর মধ্যে নৌ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী থেকে উদ্ধার হয়েছে ৩০টির বেশি লাশ। জানুয়ারিতে ১টি, ফেব্রুয়ারিতে ২টি, মার্চে ৪টি, এপ্রিলে ৩টি, মে ও জুনে ৬টি করে ১২টি, জুলাইয়ে ৩টি এবং আগস্টে ৮টি লাশ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে ১৩টি লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি।

তবে নদীতে বিভিন্নভাবেই মৃত্যু হলেও হত্যার পর লাশ নদীতে ফেলার অভিযোগ এসেছে অন্তত ৮ জনের মধ্যে পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি সোলাদানা ও কপোতাক্ষ এবং রূপসা ও ভৈরব নদীতে এ লাশগুলো পাওয়া গেছে। সব মিলে খুলনায় গত ১৬ মাসে মানুষ খুনের সেঞ্চুরির ঘটনা ঘটেছে।

খুনের নেপথ্যে মাদক ও আধিপত্য বিস্তার

আসামিদের জবানবন্দি ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, অন্তত ৬টি সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে খুলনায় মাসে অন্তত ৭০ থেকে ১০০ কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদকের এই বিশাল বাজারের নিয়ন্ত্রণে নিতে খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি চৌধুরী ওরফে গ্রেনেড বাবু, শেখ পলাশ, নুর আজিম, এবং আশিক বাহিনী প্রায় বিরোধে জড়ায়। আওয়ামী আমলে খুলনায় মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক তালিকায় নাম ছিল সাবেক কাউন্সিরর ও নগর আওয়ামী লীগ নেতা জেড এ মাহমুদ ডন, স্বেচ্ছাসেবক ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাসেল, যুবলীগ নেতা হাফেজ শামীম ও হাফিজুর রহমানের নাম।

এরা সবাই অঞ্চল ভাগ করে পুরো খুলনা অঞ্চলের মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা করতেন। মাথার উপর ছায়া হিসেবে ছিলেন শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেল। এদের হয়েই কাজ করতেন আশিক, নুর আজিম, গ্রেনেডবাবুসহ কিশোরগ্যাং থেকে মাফিয়া বনে যাওয়া সন্ত্রাসীরা।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন পুলিশের একটি অংশের সাথে যোগসাজশে মাদক সিন্ডিকেট পরিচালনা করা হতো। মাসে ৭০ থেকে একশ কোটি টাকার মাদকের লেনদেন হতো খুলনায়। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর মাদকের এ গডফাদাররা আত্মগোপনে থাকায় নিচের সারির মাদক ব্যবসায়ীরা বাজার দখলে নিতে নিজেদের মধ্যে সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়। শুধু মাদক সংশ্লিষ্টতায় খুলনায় অন্তত ২০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। 

এর মধ্যে ১২টি খুনের সঙ্গে জড়িতরা আদালতে শিকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। খুন হওয়া ব্যক্তি ও অভিযুক্তরা একই সাথে ব্যবসা করত বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। সর্বশেষ খুলনার আদালত চত্বরে খুন হওয়া হাসিব ও রাজন ছিলেন খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ পলাশের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। 

চলতি বছরের ৩০ মার্চ যৌথবাহিনীর বিশেষ অভিযানে বিপুল অস্ত্রসহ আটক করা হয় রাজন ও গ্রুপ লিডার পলাশসহ ১০ জনকে। ওই মামলায় চার্জশিটে নাম দেওয়া হয় হাসিবের। জেল থেকে জামিনে বের হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে এসেছিলেন তারা। গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যার যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সেখানে গ্রেনেড বাবু গ্রুপের সন্ত্রাসী মিজানকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। মিজানের নেতৃত্বই হামলা হয়েছিল এবং আসামিরা প্রায় সবাই শনাক্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারেও বিশেষ অভিযান চলমান রয়েছে।

উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সাধারণ মানুষ ও প্রার্থীরা

এ অস্বাভাবিক পরস্থিতির মধ্যে এগিয়ে আসছে জাতীয় সংসদ নর্বিাচন। প্রার্থীদের মধ্যে এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দিন দিন বেড়ে চলেছে, যা নির্বাচনী পরিবেশকেও ঘোলাটে করে তুলতে পারে। খুলনা-২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ও খুলনা মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘শুধু প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের নেতা, সাধারণ ভোটারও এসব নিয়ে আতঙ্কে রয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত আমাদের তাদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলছি কিন্তু পরিস্থিতি উন্নতির কোনো দৃশ্য তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না।’ 

তিনি বলেন, ‘অল্প দিনের মধ্যেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হবে। তার আগেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা প্রয়োজন, তা না হলে মানুষ আস্থা পাবে না।’ 

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাড়াটে খুনি ও অস্ত্রবাজদের কাজে লাগানোর তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র চলছে। ভোটের সময় এ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে যে কেউ কাজে লাগাতে পারে। এজন্য খুব দ্রুত বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।’

খুলনা মহানগর জামায়াতের আমির ও খুলনা-৩ আসনের প্রার্থী অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ভোটের কাজে গেলে মানুষ আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগের কথা তুলে ধরছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করতে গেলে আমাদেরও নিরাপত্তা ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। এই উদ্বেগ ও ভয় দূর করে আস্থা অর্জন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দৃশ্যমান কিছু করে দেখাতে হবে।’ 

তিনি বলেন, ‘ঘটনা ঘটার পরে দেখা যায় পুলিশের টহল ও তল্লাশি জোরদার করা হয়। কিন্তু ঘটনার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো, পেশাদার সন্ত্রাসী ও অস্ত্রবাজদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান এখন অতি জরুরি। সেই ব্যবস্থা নিতে হবে।’

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার জুলফিকার আলী হায়দার বলেন, ‘সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীদের নিরাপত্তায় বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি, বিশেষ করে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের কর্মসূচিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। প্রার্থীদের বাসভবন, কর্মসূচির স্থানে পুলিশের টহল বাড়ানো হয়েছে। তাদের দিকে সাদা পোশাকের পুলিশও নজর রাখছে।’

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow