পূর্ব লন্ডনে বাঙালিদের কারি রাজধানী খ্যাত ব্রিকলেনে শুক্র ১৯ থেকে রোববার ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ব্রিকলেন কারি ফেস্টিভাল। আয়োজনে ছিল টাওয়ার হ্যামলেট বারার মেয়র লুৎফর রহমান ও ব্রিকলেন বাংলা টাউন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন।
ব্রিকলেনের কারি সংস্কৃতিকে নতুনভাবে তুলে ধরতে দীর্ঘ প্রায় এক দশক অর্থাৎ ২০১৬ সালের পর এবার বেশ ধুমধাম করে কারি ফেস্টিভাল অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ফেস্টিভালকে কেন্দ্র বাঙালি কমিউনিটি এবং কারি লাভার সাদা ব্রিটিশদের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে।
লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেট বারার মেয়র লুৎফর রহমান বলেন, ব্রিকলেন তার প্রাণবন্ত সংস্কৃতি ও অতুলনীয় কারির জন্য সারা বিশ্বে পরিচিত – তাই আমি গর্বিত যে ২০১৬ সালের পর প্রথমবারের মতো এই প্রতীকী উৎসব আবার ফিরিয়ে আনতে পারছি। প্রায় এক দশক পর এর প্রত্যাবর্তন হলো টাওয়ার হ্যামলেটসের বিশেষত্বের এক মহোৎসব: আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাহসী স্বাদ, আর অসাধারণ কমিউনিটি।
লাভ টাওয়ার হ্যামলেটস ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে আমরা স্থানীয় ব্যবসাগুলোকে সহায়তা করছি এবং ইস্ট এন্ডের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করছি – আর এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো ব্রিকলেন কারি ফেস্টিভ্যাল। সুস্বাদু খাবার, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা আর পুরো পরিবারের জন্য নানা আয়োজন নিয়ে আমি সবাইকে আহ্বান জানাই ব্রিক লেনের সেরা অভিজ্ঞতা নিতে।
শুক্রবার ছিল উদ্বোধনী দিন। এদিনের মূল আকর্ষণ ছিল মেহেদী পেইন্টিং কর্মশালা, বাংলা ধাঁচের নাচ শেখার ক্লাস, আর ছিল ‘ড্রেসফরদ্যফেস্ট’ — যেখানে ছিল স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ব্যক্তিগত কেনাকাটার অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। শনিবার দিন ব্রিকলেনের পরিবেশ ছিল অনেকটা গতানুগতিক। বাঙালিদের থেকে বিদেশিদের আনাগোনাই বেশি ছিল। ফেস্টিভালে অংশ নেওয়া হোটেল রেস্টুরেন্টগুলো যথারীতি ২০ শতাংশ ডিসকাউন্ট বজায় রাখে এদিনেও।
বিদেশিদের অনেকটা আয়েশি ভঙ্গিতেই তাদের খাবার দাবার খেতে দেখা গেছে। কয়েকটা রেস্টুরেন্ট ফ্রি বিরিয়ানি সরবরাহ করে তবে গ্রাহককে একটা ফরম পূরণ করতে হয়। বিকেলের দিকে একঝাঁক উচ্ছল চাইনিজ মেয়েদের উপস্থিতি এবং হরেক রকম অঙ্গভঙ্গি ফেস্টিভালে আনন্দের নতুন মাত্র যোগ করে। যেহেতু কারি লাভারদের বেশির ভাগই সাদা চামড়ার ব্রিটিশ, তাই চাইনিজদের উপস্থিতিটা ফেস্টিভালকে আরো বহুমুখী করে তোলে। রেস্টুরেন্টের কর্মীদেরকে কোনো কোনো বিদেশিকে থামিয়ে তাদের খাবারের মহত্ত্ব বর্ণনা করতে দেখা গেছে।
মূল উৎসবের দিনটি ছিল রোববার। দিনের প্রারম্ভেই বাক্সটন স্ট্রিট থেকে ব্রিক লেন আর্চ পর্যন্ত একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, যেখানে ছিল থিমভিত্তিক বাঁশি বাজনা ও স্থানীয় নৃত্যশিল্পীদের নৃত্য প্রদর্শন। দুপুরজুড়ে ছিল ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী ও বিনোদনমূলক আয়োজন— যেমন ডিজে, স্টিল্ট-চালক এবং জাদু দেখানো।
পাশাপাশি বিভিন্ন রেস্তোরাঁ রাস্তার ওপর স্টল বসিয়ে পরিবেশন করে আঞ্চলিক ও বিশেষ ধরনের খাবার। এর সাথে আরো ছিল রান্নার লাইভ ডেমো, উৎসব-ভিত্তিক স্ট্রিট আর্ট আর লাইভ গ্রাফিতি শো। এদিন ছিল উপচে পড়া ভিড়। শাড়ি পরা বাঙালি রমণীদের উপস্থিতি ছিল বেশ। তাদের সাথে সাথে বাচ্চারাও ট্রেডিশনাল বাঙালি পোশাক পরে অনুষ্ঠানটিকে আরও বর্ণাঢ্য করে তোলে।
তিন দিন ধরে চলা অনুষ্ঠানটি সবার জন্য উন্মুক্ত ও এন্ট্রি ফি মুক্ত ছিল। তবে আগ্রহীদের রেজিস্ট্রেশন করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছিল এবং রেজিস্ট্রেশনকারীদের সপ্তাহান্তে অংশগ্রহণকারী রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের জন্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়।
বাংলাদেশি অভিবাসীরা, যাদের অধিকাংশই সিলেট থেকে আগত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই লন্ডনের এই অংশে বসবাস শুরু করেন। অল্প কিছুদিন পরেই গড়ে ওঠে প্রথম দিকের কারি হাউসগুলো। সত্তর ও আশির দশকের মধ্যে ব্রিক লেন রূপ নেয় ‘বাংলা টাউন’ এ — যা যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের প্রাণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। তখন থেকেই এটি ব্রিটেনে কারি উপভোগের সেরা জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।
বাংলা টাউন বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের গুলজার খান বলেন, ব্রিক লেন শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি বাংলা টাউনের আত্মা এবং আমাদের কমিউনিটির দৃঢ়তা, সৃজনশীলতা আর ব্যবসায়িক মনোভাবের প্রতীক। দশকের পর দশক ধরে আমাদের ব্যবসাগুলো আতিথেয়তার উষ্ণতা ও আমাদের খাবারের সমৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষকে একত্রিত করে আসছে।
যারা কারি ভালোবাসেন তাদের জন্য এ ফেস্টিভালটি ছিল বেশ উপভোগ্য। বিপুল সংখ্যক ব্রিটিশদের আগমন তাই প্রমাণ করে। প্রায় এক যুগ পরে যখন ফিরে এসেছে তখন এটি প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হবে এটাই কাম্য। এরকমটি হলে কেউ যদি এবার এটি মিস করে থাকে, তাহলে তাদের কোনো আফসোস থাকবে না।
এমআরএম/জিকেএস