একা একা
কুনমিংয়ে অনেক বাংলাদেশী আছেন। আর বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ প্রতি ফ্লাইটেই আসেন। যান। বিভিন্ন কাজে তারা আসেন। কেউ সঙ্গে স্পাউস আনেন, কেউ আনেন না। বাংলাদেশী কারও সঙ্গে আলাপ হলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি করেন সেটি হলো, ‘আপনি এখানে একা থাকেন?’ পুরুষরা প্রশ্নটি করার পর আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তাদের চোখে মুখে আরও প্রশ্ন ফুটে উঠলেও তা জিজ্ঞাসা করার সময় সাধারণত একটু সংকোচ বোধ করেন। নারীদের অধিকাংশই সংকোচ না করে কেন একা আছি, ‘একা থাকতে খারাপ লাগে না?’, কতদিন এভাবে থাকবো, স্বামী কি করে, স্বামী আছেন কিনা, সন্তানের কি অবস্থা এসব সিরিয়াল প্রশ্ন চালাতে থাকেন। যখন শোনেন স্বামী, সন্তান সবই আছেন, তাদের সাথে সম্পর্কও ভালো, তখন ধরে নেন আমি খুব গরীব, নিশ্চয়ই টাকার জন্য এত কষ্ট করে একা একা দূরদেশে পড়ে আছি। তারা তখন আমাকে পরামর্শ দেন যেন তাড়াতাড়ি দেশে চলে যাই। অনেকে যোগ করেন, ‘টাকাটাই তো আর সব নয়’। এরা বুঝতেই পারেন না যে, একজন মানুষ একা থাকাটা পছন্দও করতে পারেন। আমি আমার চাকরিটাকে খুব এনজয় করি। চাকরিটা বেশ সম্মানজনক এবং সন্তোষজনক। এখানকার প্রকৃতিও খুব সুন্দর। আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় পাহাড়,
কুনমিংয়ে অনেক বাংলাদেশী আছেন। আর বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ প্রতি ফ্লাইটেই আসেন। যান। বিভিন্ন কাজে তারা আসেন। কেউ সঙ্গে স্পাউস আনেন, কেউ আনেন না।
বাংলাদেশী কারও সঙ্গে আলাপ হলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি করেন সেটি হলো, ‘আপনি এখানে একা থাকেন?’ পুরুষরা প্রশ্নটি করার পর আমার জবাব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। তাদের চোখে মুখে আরও প্রশ্ন ফুটে উঠলেও তা জিজ্ঞাসা করার সময় সাধারণত একটু সংকোচ বোধ করেন। নারীদের অধিকাংশই সংকোচ না করে কেন একা আছি, ‘একা থাকতে খারাপ লাগে না?’, কতদিন এভাবে থাকবো, স্বামী কি করে, স্বামী আছেন কিনা, সন্তানের কি অবস্থা এসব সিরিয়াল প্রশ্ন চালাতে থাকেন। যখন শোনেন স্বামী, সন্তান সবই আছেন, তাদের সাথে সম্পর্কও ভালো, তখন ধরে নেন আমি খুব গরীব, নিশ্চয়ই টাকার জন্য এত কষ্ট করে একা একা দূরদেশে পড়ে আছি। তারা তখন আমাকে পরামর্শ দেন যেন তাড়াতাড়ি দেশে চলে যাই। অনেকে যোগ করেন, ‘টাকাটাই তো আর সব নয়’।
এরা বুঝতেই পারেন না যে, একজন মানুষ একা থাকাটা পছন্দও করতে পারেন। আমি আমার চাকরিটাকে খুব এনজয় করি। চাকরিটা বেশ সম্মানজনক এবং সন্তোষজনক। এখানকার প্রকৃতিও খুব সুন্দর। আমার বাসার বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায় পাহাড়, নীল আকাশ, ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়ের দারুণ সুন্দর ক্যাম্পাস, লেক, স্পোর্টস গ্রাউন্ড। শীতের সকালে বারান্দায় এসে পড়ে মিষ্টি রোদ। গরমে দক্ষিণের বাতাস। ক্লাস না থাকলে আমি প্রায়ই এখানে ওখানে ঘুরতে যাই। শপিংয়ে, পার্কে। কফিশপে বা রোডসাইড রেস্টেুরেন্টে বসে আমার পছন্দের খাবার খাই।
২০১১ সালে প্রথম চীন বেতারের চাকরি নিয়ে বেইজিং যাই। তখন একা হলেও একই অ্যাপার্টমেন্টে আরও দুজন নারী ছিলেন। যার যার বেডরুমে সে সে থাকলেও ড্রইং, ডাইনিং, কিচেন ছিল কমন। ফলে তেমন একা লাগতো না। ২০১৮-২০ সালে যখন কুনমিং ছিলাম ইউননান মিনজু ইউনিভারসিটিতে চাকরির সুবাদে তখন আলাদা ছোট অ্যাপার্টমেন্ট ছিল। তবে আমি যাবার মাস দুয়েকের মধ্যেই অর্ণ চলে এসেছিল। অর্ণ তখন ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিল বলে আমার সঙ্গেই থাকতো। শাহিনও কয়েক মাসের জন্য আমাদের কাছে এসেছিল। তাই একা লাগার প্রশ্ন ওঠেনি।তাছাড়া সেখানে বেশ বন্ধুবান্ধবও ছিল আমার। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই ফরেন টিচাররা সবাই থাকতেন তাই কখনও একা মনে হয়নি। বরং দলবেঁধে ঘোরা, হুইহুল্লোড়ে সময় যে কিভাবে কাটতো তা বুঝতামই না।
এবার ইউননান বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়ে আসার পর একেবারেই একা আছি বেশ বড় একটি অ্যাপার্টমেন্টে। এটি ক্যাম্পাসের খুব কাছে। তবে ক্যাম্পাসের ভিতরে নয়। আমি চাইলে অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়েরই অন্য একটি ক্যাম্পাসে হোস্টেলে থাকতে পারি। সেটিতে অনেক ফরেন টিচার থাকেন। কিন্তু তাহলে ক্লাসের দিন সকালে একঘন্টা শাটল বাসে চড়ে এই ক্যাম্পাসে আসতে হবে।
প্রথম কয়েক সপ্তাহ একা একা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে খুব মন খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন বরং নিজেকে সময় দিতে ভালোই লাগে। ইচ্ছা হলেই ভিডিও কলে শাহিন, অর্ণ, ভাইয়ার সাথে কথা বলা যায়।
সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ডিনার সেরে নিয়ে আমি ঘরের ভিতর হিটার জ্বালিয়ে কফির কাপ হাতে বসে থাকি। কোন বই ডাউনলোড করে পড়ি। অথবা মুভি দেখি। হলিউডের মুভি এখনও পছন্দ করি সেই কিশোরবেলার মতোই।
কুনমিংয়ের প্রকৃতি যে কি সুন্দর তা যারা এখানে এসেছেন তারা জানেন। পুরো শহরটাই পাহাড়ের কোলে। ন্যাড়া পাহাড় নয়। সবুজ অরণ্যে ঢাকা পাহাড়। এখন শীতের শুরুতে তাতে হলুদ ও লালের ছোপ পড়েছে। মনে পড়ে প্রিয় গান ‘রকি মাউন্টেন হাই’ অথবা জন ডেনভারের কান্ট্রি রোডস টেক মি হোম গানের ‘ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অলমোস্ট হেভেন’ সেই লাইন। কুনমিং সত্যিই অলমোস্ট হেভেন।
আমার খুব অবাক লাগে বাংলাদেশীদের(সকলের নয়, অধিকাংশের) মানসিকতা দেখে। ২০২৫ সালে এসেও ‘আমি যে বেশ সুখে আছি, অন্তত নই দুঃখে কৃশ’ একথাটা প্রমাণ করতে হচ্ছে। সাংসারিক বা দাম্পত্য ঝগড়াঝাটি না থাকলেও একজন মধ্যবয়সী নারী (আমি যদিও নিজেকে তরুণ ভাবি) নিজের মতো একা থাকাটাকে পছন্দ করতে পারে এবং তার পরিবারের সদস্যরাও এটাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারে এটা যেন এরা ভাবতেই পারছেন না। ‘হায় হায়, কিভাবে একা থাকেন, ভয় লাগে না?’ শুনতে শুনতে অস্থির হলাম।
আমি অবশ্য বছরে প্রায় তিন মাস ঢাকায় থাকি। কারণ ‘নদীও ঘরে ফেরে’।
বই পড়া, মুভি দেখা, লেখা, বেড়ানো সব মিলিয়ে একজন একা মানুষও আজকাল এই ফেসবুকের যুগে মোটেই একা নয় এটা যারা জানেন তারা বোঝেন। আমার মতো যারা একা আছেন তাদের বলছি, নিজের সঙ্গ নিশ্চয়ই ভালো লাগে আপনার। তাহলে নিজে নিজে ভালো থাকতে শিখুন। বিদেশে তো বটেই, আজকাল ঢাকাতেও অনেক নারী বেশ একা একা থাকেন। দিব্যি ভালো আছেন তারা।
আমি বলছি না যে, পরিবারের সঙ্গে থাকায় কোন সমস্যা আছে। বলতে চাচ্ছি যদি কোন কারণে (সেটা কাজ বা অন্য যে কারণেই হোক) একা থাকতে হয় তাহলে সেই জীবনটাও যথেষ্ট ভালোভাবে যাপন করা যায়, আনন্দে থাকা যায়।
এইচআর/জেআইএম
What's Your Reaction?