একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর কী হচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে-বাইরে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সেই খবর জানতে পারে কিছুটা পরে, রেডিওর মাধ্যমে। যদিও কিছু মানুষ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে ওই দিন দুপুর ১২টার দিকেই যারা ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখেছিলেন, তারা রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে ঢাকায় আগে থেকেই আত্মগোপনে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেন। গবেষকদের মতে, ‘সারেন্ডার’ বা আত্মসমর্পণ কীভাবে হবে—তা নিয়ে উদ্বেগ বা শঙ্কা থাকলেও ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করার পর বিজয় যে নিশ্চিত, তা নিয়ে কার্যত কারও মধ্যে আর কোনো সংশয় ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১–২০১১’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রবেশ করে মার্কিন সপ্তম নৌবহর। বিকেল ৫টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত–বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। মেজর জেনারেল জ্যাকবের প্রস্তুত

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর কী হচ্ছিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে-বাইরে

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ সেই খবর জানতে পারে কিছুটা পরে, রেডিওর মাধ্যমে। যদিও কিছু মানুষ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। তবে ওই দিন দুপুর ১২টার দিকেই যারা ভারতীয় বাহিনীকে ঢাকায় প্রবেশ করতে দেখেছিলেন, তারা রাস্তায় নেমে আসেন। একই সঙ্গে ঢাকায় আগে থেকেই আত্মগোপনে থাকা মুক্তিবাহিনীর সদস্যরাও প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসেন।

গবেষকদের মতে, ‘সারেন্ডার’ বা আত্মসমর্পণ কীভাবে হবে—তা নিয়ে উদ্বেগ বা শঙ্কা থাকলেও ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করার পর বিজয় যে নিশ্চিত, তা নিয়ে কার্যত কারও মধ্যে আর কোনো সংশয় ছিল না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তার ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১–২০১১’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। একই সময়ে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে প্রবেশ করে মার্কিন সপ্তম নৌবহর। বিকেল ৫টায় ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারত–বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা শর্তহীন আত্মসমর্পণ করে। মেজর জেনারেল জ্যাকবের প্রস্তুত করা আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ. এ. কে. নিয়াজী ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।’

বিবিসিতে ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর অ্যালান হার্টের একটি তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়। সেখানে দেখা যায়, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসছেন এবং মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছে।

রিপোর্টের ফুটেজে দেখা যায়, মানুষ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছে। যদিও তখনো কোথাও কোথাও গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এরই একপর্যায়ে ভারতীয় বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে তাদের ঘিরেও উল্লাসে ফেটে পড়ে মানুষ।

গবেষকদের মতে, ক্যান্টনমেন্টে যখন আত্মসমর্পণের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত হচ্ছিল, তখনও বাইরে অনেক মানুষ উদ্বিগ্ন ছিলেন—আসলে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে। যে সেদিনই আত্মসমর্পণ হবে এবং বাংলাদেশ সম্পূর্ণ মুক্ত হবে, বিষয়টি তখনো অনেকের কাছেই স্পষ্ট ছিল না।

লেখক ও গবেষক মফিদুল হক জানান, ক্যান্টনমেন্টে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা এবং পাকিস্তানের মেজর জেনারেল জামশেদসহ উভয় পক্ষের মধ্যে বৈঠক চলছিল। বাইরে ছিল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা— কীভাবে সারেন্ডার হবে তা নিয়ে।

১৬ ডিসেম্বরের ঢাকার পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আলোচনা চলাকালেই ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। যারা তাদের আসতে দেখেছিল, তারাও রাস্তায় নেমে আসে। ঢাকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও বেরিয়ে আসে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক ও প্রত্যক্ষদর্শী আফসান চৌধুরী বলেন, ‘ক্যান্টনমেন্টে কী হচ্ছে, তা মানুষের জানা ছিল না। বরং ঢাকার রাস্তায় মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীকে দেখেই মানুষ চিৎকার করছিল, জয় বাংলা স্লোগান দিচ্ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ডিসেম্বরজুড়েই চারদিক থেকে ঢাকায় প্রবেশ করেছে। পাকিস্তান বাহিনী হেরে গেছে— এই উপলব্ধিই মানুষের মধ্যে ছিল। সারেন্ডারের খবর পরে সবাই রেডিওতেই পেয়েছে।’

১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজের বাহিনীর সঙ্গে ঢাকায় প্রবেশ করেন প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা মইনুল হোসেন চৌধুরী। পরে দৈনিক প্রথম আলোতে লেখা এক নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন,
‘সন্ধ্যায় আমরা ঢাকা স্টেডিয়ামে পৌঁছি। পথে পথে রাস্তাঘাট ছিল জনশূন্য। যদিও পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল, তবু মানুষের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক ও সন্দেহ ছিল। ফলে রাস্তায় লোকজনের চলাচল ছিল না।’

ক্যান্টনমেন্টে কী হচ্ছিল
 

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের যৌথ নেতৃত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।

এর আগে সকাল থেকেই ক্যান্টনমেন্টে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা ও পাকিস্তানের মেজর জেনারেল জামশেদের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়।

৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই পরিস্থিতি দ্রুত পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া ৯টায় জেনারেল মানেকশ ফোন করে তাকে সেদিনই ঢাকায় গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন।’

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ এবং রাও ফরমান আলী খানের ‘হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেট’ গ্রন্থেও ওই দিনের ক্যান্টনমেন্টের ঘটনাবলি বর্ণিত হয়েছে।

বইগুলোতে বলা হয়, ওই দিন সকালে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে থাকাকালে মেজর জেনারেল নাগরার একটি লিখিত বার্তা পৌঁছে। সেখানে লেখা ছিল— ‘প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।’

এরপর নাগরাকে নিরাপদে শহরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, ‘ভারতীয় জেনারেল হাতে গোনা সৈন্য নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলেন। তখনই কার্যত ঢাকার পতন ঘটে।’

কমান্ড অফিসে পৌঁছানোর পর নিয়াজী ও নাগরার মধ্যে কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তাও হয়, যা সিদ্দিক সালিকের ভাষায় এতটাই অশালীন ছিল যে বইয়ে প্রকাশযোগ্য নয়।

রাও ফরমান আলী খান লিখেছেন, নিয়াজী তার চেয়ারে বসা, সামনে নাগরা, আর পাশে মুক্তিবাহিনীর টাইগার সিদ্দিকী (কাদের সিদ্দিকী)। তিনি শুনেছেন, নিয়াজী নাগরাকে জিজ্ঞেস করছিলেন—তিনি উর্দু কবিতা বোঝেন কি না।

এরপর ঢাকায় এসে পৌঁছান জেনারেল জ্যাকব। তিনি আত্মসমর্পণের দলিল হস্তান্তর করেন। তবে নিয়াজী একে ‘যুদ্ধবিরতির খসড়া’ বলে আখ্যা দেন। দলিলে ‘ভারতীয় যৌথ কমান্ড ও বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ’ কথাটি থাকায় আপত্তি ওঠে। জবাবে বলা হয়— এটি ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে আত্মসমর্পণ সম্পন্ন হয়। নিয়াজী তার রিভলভার ও ব্যাজ অরোরার হাতে তুলে দেন। রেসকোর্স ময়দানে তখন জনতা পাকিস্তানবিরোধী স্লোগানে মুখর।

ক্যান্টনমেন্টের বাইরের পরিস্থিতি
 

ক্যান্টনমেন্টে কী ঘটছে, তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় ছিল না। তবে বেলা ১১টার দিকেই অনেকের কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে— যুদ্ধ শেষের পথে।

শহরের বিভিন্ন এলাকায় তখন মুক্তিযুদ্ধের গান, মিছিল, মিষ্টি বিতরণ ও উল্লাস চলছিল। বিকেলে আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকাজুড়ে ফাঁকা গুলির শব্দ ও স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ।

তবে কোথাও কোথাও তখনও গোলাগুলি হচ্ছিল। মিরপুর, নয়াবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় উত্তেজনা ছিল। এর মধ্যেই পাড়া-মহল্লা থেকে বের হয় মিছিল, উচ্চারিত হয় একটাই স্লোগান— ‘জয় বাংলা’।

আফসান চৌধুরী বলেন, ‘মানুষ তখন মুক্তির আনন্দে উল্লসিত। দেশ সত্যিই স্বাধীন হলো। তবে একদিন পর থেকেই আইনশৃঙ্খলার অবনতি শুরু হয়।’

সূত্র : বিবিসি বাংলা

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow