এবারও চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা

3 months ago 44

• সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের প্রস্তুতি
• চামড়ার আকার ও দাম নিয়ে ফাঁকি

ঈদুল আজহা সামনে রেখে চট্টগ্রামে এবার সাড়ে তিন লাখ কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। চট্টগ্রামে ট্যানারি কম। ব্যবসায়ীদের চামড়া সংগ্রহ করতে হয় ঢাকার কথা মাথায় রেখে। তাদের অভিযোগ, ঢাকার ব্যবসায়ীরা প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের সংগ্রহ করা চামড়ার দাম দিতে চান না। বিগত দুই বছরের মতো এবারও সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা তাদের।

চট্টগ্রামে সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য
এবার কোরবানিতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছেন ব্যবসায়ীরা। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর তিন লাখ ৪২ হাজার গরু ও মহিষের চামড়া সংগ্রহ করা হয়েছিল। চট্টগ্রামে সাড়ে তিন লাখ কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এবার লবণের দাম গত বছরের তুলনায় কিছুটা কম। তবে গত ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে গত ১৫ দিনে লবণের দাম প্রতি বস্তায় (৭৪ কেজি) একশ টাকার মতো বেড়েছে।’

‘চট্টগ্রামে একসময়ে চামড়ার ব্যবসা ছিল রমরমা। আমাদের সমিতির সদস্য ছিল আড়াইশর মতো। এখন সেখানে একশর নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে নিয়মিত ব্যবসা করেন ৩০-৪০ জন। ২০১৮ সালের আগে কয়েকবছর ঢাকার ট্যানারি মালিকরা ২০-২৫ কোটি টাকা আটকে দেয়। সেই টাকা এখনো পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৯ সাল থেকে তারা নিয়মিতভাবে টাকা পরিশোধ করে চামড়া নিচ্ছে। এবার আড়তগুলোতে টাকার তেমন সমস্যা নেই। তবে ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে মৌসুমি ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে চট্টগ্রামে চামড়া সংরক্ষণ আরও ভালো হতো।’

গত কয়েক বছরে অনেক চামড়া ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোরবানি সামনে রেখে কয়েকজন কয়েকজন মিলে যৌথভাবে চামড়া চামড়া সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। অনেকে চামড়া লবণজাত করার জন্য জায়গাও ভাড়া করেছে।- চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন

তিনি বলেন, ‘গত কয়েক বছরে অনেক চামড়া ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছে। কোরবানি সামনে রেখে কয়েকজন কয়েকজন মিলে যৌথভাবে চামড়া চামড়া সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নিয়েছে। অনেকে চামড়া লবণজাত করার জন্য জায়গাও ভাড়া করেছে।’

চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম
কোরবানি সামনে রেখে পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে গত বছরের চেয়ে এবার ঢাকার মধ্যে প্রতি বর্গফুট চামড়ায় ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা করে বেড়েছে।

এবারও চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। গত বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। ঢাকার বাইরে হিসেবে চট্টগ্রামে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ট্যানারি ব্যবসায়ীদের কিনতে হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। চট্টগ্রামে গত বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা।

আরও পড়ুন

পাশাপাশি সারাদেশে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের লবণযুক্ত খাসির চামড়া কিনতে প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা দিতে হবে। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। অন্যদিকে বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা দিতে হবে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা।

চামড়ার আকার ও দাম নির্ধারণে ‘ফাঁকি’
সরকার পশুর চামড়া দাম নির্ধারণ করে দিলেও প্রান্তিক ব্যবসায়ী কিংবা কোরবানি দেওয়া লোকজন চামড়ার সঠিক মূল্য পান না। অনেক সময় ধর্মীয় কিংবা দাতব্য সংস্থাগুলোকে বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দেন কোরবানিদাতারা। অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার আকার নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যে কারণে কোরবানিদাতা পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে ছোট গরু-মহিষের চামড়া একশ থেকে দুইশ টাকায়, আকারে বড় গরু-মহিষের চামড়া আড়াইশ থেকে তিনশ টাকায় বিক্রি হয়।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রামে একটি মাত্র ট্যানারি রয়েছে। চট্টগ্রামে ট্যানারির সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়ায় চামড়া চাহিদাও কমে গেছে। চট্টগ্রামে কোরবানি পশু চামড়ার বড় অংশই ঢাকাকেন্দ্রিক ট্যানারির জন্য সংগ্রহ করা হয়। তাই দামও কম।

এবারও চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা

হালিশহর এলাকার ব্যবসায়ী আলী হোসেন। তিনি প্রতিবছর কোরবানি দেন। আলী হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘১০-১২ বছর আগেও কোরবানির পশুর চামড়ার ন্যায্য দাম পাওয়া যেত। আগে ৫ মণ সাইজের একটি গরুর চামড়ার দামও দেড়-দুই হাজার টাকায় বিক্রি হতো। এখন সেই চামড়া দুইশ টাকাতেও বিক্রি হচ্ছে না। অথচ দেশে কিংবা বিদেশে চামড়াজাত সব ধরনের পণ্যের দাম এ সময়ে দ্বিগুণের চেয়ে বেশি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কোরবানিদাতার পশুর চামড়াগুলো গরিবের হক। কোরবানিদাতা পর্যায়ে চামড়ার দাম না পাওয়া মানে গরিবের হক নষ্ট হওয়া। আর এসব গরিবের হক যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।’

ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে চট্টগ্রামে সরকার নির্ধারিত চামড়া দাম পাওয়া যায় না এমন অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের অভিযোগটির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আশা করছি এবার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা চামড়ার যথাযথ দাম পাবেন।’- বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় মনিটরিং টিমের দলনেতা মোহাম্মাদ রুহুল আমীন

বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি মো. মুসলিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ট্যানারি মালিকদের জন্য চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে কয়েক হাত বদল হয়ে ট্যানারিতে চামড়া যায়। অথচ অনেক কোরবানিদাতা কিংবা মৌসুমি ব্যবসায়ী মনে করেন, সরকারের নির্ধারিত দামে আড়তদাররা চামড়া কিনবেন।’

তিনি বলেন, ‘গ্রাম পর্যায়ে কোরবানিদাতাদের কাছ থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়া সংগ্রহ করেন। তাদের কাছ থেকে আড়তদাররা কেনেন। এরপর আড়তদাররা এসব চামড়া আড়তে নিয়ে লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করেন। লবণযুক্ত সেই চামড়াই ট্যানারি মালিকরা সরকার নির্ধারিত দামে কেনেন। তার মধ্যে ট্যানারি মালিকরা চামড়া কেনার সময় ২০ শতাংশ কেটে চামড়া নেন।’

মিলছে না সরকার নির্ধারিত দাম
গত কয়েকবছর ধরে সরকার ট্যানারি পর্যায়ে কোরবানির পশু চামড়া সংগ্রহে দাম নির্ধারণ করে দিলেও ঢাকার ট্যানারি মালিকরা তা মানছেন না বলে অভিযোগ চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের। বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত দুই বছর চট্টগ্রামের আড়তদার ব্যবসায়ীরা চামড়ার সঠিক দাম পায়নি। ঢাকার ট্যানারি মালিকদের উপস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার দাম নির্ধারণ করেন। অথচ সেই ট্যানারি মালিকরা চট্টগ্রাম থেকে মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দাম দেন না। এ কারণেও চট্টগ্রামের অনেক আড়তদার চামড়া সংরক্ষণে বিমুখ হচ্ছেন।’

এবারও চামড়ার সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় মনিটরিং টিমের দলনেতা বাংলাদেশ চা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মাদ রুহুল আমীন চামড়া ব্যবসায়ীদের এ অভিযোগটি স্বীকার করে জাগো নিউজকে বলেন, বলেন, ‘চট্টগ্রামে সুন্নিয়া মাদরাসাকেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। আমরা শুক্রবার সুন্নিয়া মাদরাসা পরিদর্শন করেছি। তারাও কাঁচা চামড়া লবণজাত ও সংরক্ষণের প্রস্তুতি নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তাদেরও লবণ দিয়ে যথাযথভাবে চামড়া সংরক্ষণ করতে বলা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে চট্টগ্রামে সরকার নির্ধারিত চামড়া দাম পাওয়া যায় না এমন অভিযোগ রয়েছে চট্টগ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীদের। আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে এ অভিযোগের বিষয়ে নোট নিয়েছি। এরই মধ্যে ব্যবসায়ীদের অভিযোগটির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। আশা করছি এবার চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা চামড়ার যথাযথ দাম পাবেন।’

এমডিআইএইচ/এএসএ/এএসএম

Read Entire Article