এবারের ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি

2 weeks ago 17

এক সময় শুধু বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ ছিল। এখন সারা বছরই ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। শীত চলে এলেও প্রতিদিন শতাধিক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে অনেকে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা সামান্য কিছু কমলেও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। গত বছরের ১ থেকে ৭ ডিসেম্বর সারাদেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল চার হাজার ২৬৯ জন। মৃত্যু হয়েছিল ২১ জনের। এবার প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে চার হাজার ১৬৩ জন। মারা গেছে ৩৪ জন। ২০২২ সালে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল দুই হাজার ৯১ জন। মৃত্যু হয়েছিল ছয়জনের।

২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৯৫ হাজার ৬৩২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, যার মধ্যে ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৮০ শতাংশ নারী। একই সময়ে ৫২২ জন মৃত্যুবরণ করেছে, যাদের মধ্যে ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ।

অক্টোবরে আক্রান্ত বেশি, নভেম্বরে মৃত্যু

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চলতি বছরের নভেম্বর মাসে সবচেয়ে বেশি ১৭৩ জন রোগী মারা গেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অক্টোবর মাসে মারা যায় ১৩৫ জন। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে অক্টোবর মাসে, ৩০ হাজার ৮৭৯ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নভেম্বর মাসে আক্রান্ত হয়েছে ২৯ হাজার ৬৫২ জন। অক্টোবর ও নভেম্বরের সেই রেশ এখনো রয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার বংশবিস্তারের অনুকূল পরিবেশ বৃষ্টিপাত। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হয়ে শীতের বিস্তার ঘটলেও এখনো রয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৫৫ জন ও মৃত্যু হয়েছে ১৬ জনের, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত হয়েছে ৩৩৯ জন ও মৃত্যু হয়েছে পাঁচজনের। মার্চ মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৩১১ জন ও মৃত্যু হয়েছে ছয়জনের। এরপরই বাড়তে শুরু থাকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা।

এপ্রিলে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ৫০৪ জন ও মৃত্যু হয়েছে দুজনের, মে মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৬৪৪ জন ও মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুন মাসে আক্রান্ত হয়েছে ৭৯৮ জন ও মৃত্যু হয়েছে আটজনের।

জুলাই মাসে আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৬৬৯ জন ও মারা গেছে ১৪ জন, আগস্ট মাসে আক্রান্ত হয়েছে ছয় হাজার ৫২১ জন ও মারা গেছে ৩০ জন। সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৯৭ জন ও মারা গেছে ৮৭ জন।

গত ১ ডিসেম্বর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় ৮৮২, মারা যায় ছয়জন; ২ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ৭০৫, মারা যায় তিনজন; ৩ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ৬২৯, মারা যায় সাতজন; ৪ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ৬২৯, মারা যায় পাঁচজন, ৫ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ৫৭০ ও মারা যায় পাঁচজন, ৬ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ১৮৬ ও মারা যায় তিনজন এবং ৭ ডিসেম্বর আক্রান্ত হয় ৫২২ জন ও মারা যায় পাঁচজন।

যে তিন মাসে সংক্রমণের হার বেশি থাকে

বিগত বছরগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ডেঙ্গু সংক্রমণের হার আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে সবচেয়ে বেশি। এরপর শীতের সময় এলে বৃষ্টিপাত কম হলে এর হার অনেকটা কমে আসে। নভেম্বরে দেশে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয় শীতে শুরু হয়। বৃষ্টিপাত না থাকায় মশার বিস্তারও কমে যায়। তবে নভেম্বর শেষ হয়ে ডিসেম্বর এলেও ডেঙ্গু প্রকোপ এখনো কমেনি।

কীটতত্ত্ববিদরা নিয়মিত জরিপ পরিচালনা করছে মশার অবস্থান জানতে। তারা জানান, জরিপে দেখা গেছে বর্ষা মৌসুম শেষ দিকে এসেও যেখানে বৃষ্টির পানি জমে আছে সেখানে এডিসের লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। আবার বৃষ্টির পানি না থাকলেও সাধারণ গৃহস্থালি ব্যবহারের পানি যেখানে জমে থাকে সেখানেও লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। বহুতল ভবনের পার্কিংয়ের জায়গা, নির্মাণাধীন ভবনের বেজমেন্ট, ওয়াসার মিটার বাক্স এবং বাসাবাড়িতে জমিয়ে রাখা পানিতে লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।

‘যথাযথ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার অভাবে মশক নামক ছোট্ট কীটটি কতটা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে সেটির বার্তা দিচ্ছে। মশার ভেতর বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পরিবর্তিত শরীরে কত স্বাচ্ছন্দ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেটাই জানান দিচ্ছে।’- অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার

‘ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল রোগ নয়’

জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. গোলাম ছারোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, গতানুগতিক ধারায় নভেম্বরে এডিস মশার প্রজননের জন্য অতটা অনুকূল পরিবেশ থাকে না। এ সময় ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড দেখিয়ে দিচ্ছে পরিবর্তিত পরিবেশের প্রভাব কতটা মারাত্মক ও ভয়াবহ। যথাযথ বৈজ্ঞানিক নীতিমালার অভাবে মশক নামক ছোট্ট কীটটি কতটা প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে সেটির বার্তা দিচ্ছে। মশার ভেতর বেড়ে ওঠা ডেঙ্গু ভাইরাস মশার পরিবর্তিত শরীরে কত স্বাচ্ছন্দ্যে মিউটেশন ঘটিয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে সেটাই জানান দিচ্ছে।

আরও পড়ুন

ডা. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ‘ডেঙ্গু এখন আর সিজনাল রোগ নয়। এডিস মশাও শুষ্ক মৌসুমকে আর তেমন পাত্তা দিচ্ছে না। এ থেকে বাঁচতে এখনই মশা ও ভাইরাসের প্রতিরোধী মাত্রা নির্ণয় করে উপযোগী কীটনাশক এবং বহুমাত্রিক ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে।’

এবারের ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেশি

এ অবস্থায় প্রত্যেককে নিজ বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার রাখা দরকার বলে মনে করছেন কীটতত্ত্ববিদরা। এছাড়া কোনো পাত্রে যাতে পানি না জমে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক থেকে সিটি করপোরেশন কোনো পক্ষই তেমন পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েক দিন থেকে এডিস মশার ঘনত্ব কমছে। আশা করি ডিসেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ডেঙ্গু কমতে শুরু করবে। তবে অনেক কমবে না, অন্য বছর যেমন শীতে ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু কমে যায়, সেটা এবার হবে না।’- অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার

‘ডেঙ্গু জানুয়ারিতে বেশ ভালো কমে যাবে’

ডেঙ্গু সংক্রমণ কখন কমতে পারে জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমরা যে ফরকাস্টিং তৈরি করি, সেখানে এডিস মশার ঘনত্ব, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা মিলিয়ে করি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েক দিন থেকে এডিস মশার ঘনত্ব কমছে। আশা করি ডিসেম্বরের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকেই ডেঙ্গু কমতে শুরু করবে। তবে অনেক কমবে না, অন্য বছর যেমন শীতে ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গু কমে যায়, সেটা এবার হবে না। ডিসেম্বরের এক সপ্তাহ পর থেকে কমতে শুরু করবে, জানুয়ারিতে বেশ ভালো কমে যাবে।’

আরও পড়ুন

চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ ডেন-২ ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছে। এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের মধ্যে যারা ক্রনিক ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন তাদের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। এছাড়া দেরিতে হাসপাতালে আসাও মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

এবারও ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে বছরজুড়ে। প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি না হলেও ঢাকা-চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। এবার ‘অ্যাক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে’ মৃত্যুহার বাড়ছে।- বিপিএমসিএ সভাপতি এম এ মুবিন খান
‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু শীত-গ্রীষ্ম মানছে না’

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এম এ মুবিন খান গত ১ ডিসেম্বর এক আলোচনা সভায় বলেন, এবারও ডেঙ্গুর প্রকোপ চলছে বছরজুড়ে। প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা। জেলা শহরগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি না হলেও ঢাকা-চট্টগ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। এবার ‘অ্যাক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে’ মৃত্যুহার বাড়ছে। সাধারণত দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বর্ষার আগে শুরু হয়। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু ভাইরাসবাহিত মশা শীত-গ্রীষ্ম মানছে না, বছরব্যাপী প্রজনন এবং বংশবিস্তার করছে।

বিপিএমসিএ সভাপতি বলেন, পৃথিবীতে যেসব শহর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে, দেখা যায় তারা সারাবছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায়, যেন কোথাও পানি জমে না থাকে। বিশেষ করে পাশের কলকাতা শহর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা করপোরেশন সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজ করছে।

আরও পড়ুন

‘তাদের প্রতিটি ওয়ার্ডে কর্মী আছেন, যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল পানি জমে কি না কোথাও সেটার ওপরে নজর রাখে। এছাড়া শহরের প্রতিটা হাসপাতাল বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে বা ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়। ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’ বলছিলেন এম এ মুবিন খান।

এএএম/এমএমএআর/জেআইএম

Read Entire Article