ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ইসলাম

2 days ago 8

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘এবং তোমরা সবাই আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিভক্ত হয়ো না। আর তোমাদের প্রতি আল্লাহর সেই অনুগ্রহ স্মরণ কর যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনি তোমার হৃদয় প্রীতির বাঁধনে বেঁধে দিলেন এবং তোমরা তারই অপার অনুগ্রহে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা এক অগ্নিকুণ্ডের কিনারায় ছিলে, তিনি তোমাদের তা থেকে রক্ষা করলেন। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তার আয়াতসমূহ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা হিদায়াত লাভ কর’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩)।

এই আয়াত অনুসারে আমরা যদি জীবন পরিচালনা করি তাহলে আমাদের মাঝে আজ যে মতভেদ আর অনৈক্য, পরস্পর বিভক্তি তা দূর হবে। আমাদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত থাকবে ঐক্য। জাতীয় ও ধর্মীয় ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। আর এই ঐক্যই আমাদেরকে এক উম্মতে পরিণত হবার নিশ্চয়তা প্রদান করবে, যার ফলে আমরা এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হতে পারব।

মুসলিম বিশ্বের শক্তির জন্য অত্যাবশ্যক হচ্ছে ঐক্য। আমরা যদি আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি আর মহানবির (সা.) পরিপূর্ণ অনুসরণ করে চলি তাহলে মুসলিম বিশ্ব থেকে নৈরাজ্য যেমন দূর হবে তেমনি ইসলাম ফিরে পাবে সেই হারানো গৌরব।

পবিত্র কুরআনের আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘তুমি বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ কর। (এমনটি হলে) আল্লাহও তোমাদের ভালোবাসবেন’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত:৩১)।

এই নির্দেশ অনুসারে মহানবির (সা.) আনুগত্য ছাড়া আল্লাহর ভালোবাসা লাভ হতে পারে না আর নাই জাতির শৃঙ্খলা ও ঐক্য বজায় থাকতে পারে।

মহানবির (সা.) তিরোধানের পর খেলাফতে রাশেদাই হচ্ছে আল্লাহর সেই মজবুত রজ্জু, যার মাঝে ধর্মীয় ঐক্য ও শৃঙ্খলা নিহিত ছিল।

হজরত আবু দারদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, মহানবি (সা.) বলেছেন, ‘আমার পরে আবু বকর এবং উমরের অনুসরণ কর। কেননা, তার দু’জন খোদার সেই দীর্ঘ রজ্জু, যে এই দু’জনকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবে সে যেন এমন এক হাতল ধরেছে যা ভাঙবার নয়’ (তফসির দূররে মনসুর, প্রথম খণ্ড, পৃ: ৫৮৪)।

কাজেই আকাশ থেকে নেমে আসা এই খোদার রজ্জু হচ্ছে, প্রথমে নবুয়ত আর পরবর্তীতে খেলাফত, যা মানবজাতির জন্য একটি বিপ্লব সৃষ্টিকারী, অনুসরণীয় ও ঐতিহাসিক যুগের সূচনা করে।

অতএব, ৬১০ সনে যখন আল্লাহতায়ালা আরবের মরুভূমি এবং অনুর্বর উপত্যকার শহর পবিত্র মক্কায় শ্রেষ্ঠনবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে ইসলামের বীজ বপন করেন। আরব জাতি হিংস্র জন্তুর মত স্বভাব, নৈতিকতা বিবর্জিত এবং সর্বপ্রকার ঘৃণ্য আচার-আচরণ এবং নির্লজ্জতা নিয়ে গৌরবকারী, দাম্ভিক ও বিদ্রোহী মনোভাব সম্পন্ন জাতি ছিল, যে কারণে সে যুগের সংস্কৃতিশীল ও শক্তিশালী দু’টি বড় বড় সাম্রাজ্য অর্থাৎ ইরান ও রোম তাদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদেরকে নিজেদের অধীন রাখাও পছন্দ করতো না।

এই অসভ্য ও বর্বর জাতি যখন মহানবির (সা.) মতো পবিত্রকারী ও সম্মানিত রাসুলের আঁচল ধরে, তার দাসত্ব বরণ করে এবং খোদার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে নেয় তখন তাদের জীবনাচার পাল্টে যায়। তারা অসভ্য হতে মানুষ এবং মানুষ হতে উন্নত স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী মানুষ আর উত্তম স্বভাবের মানুষ হতে খোদাপ্রেমী মানুষে পরিণত হয়।

পাঁচবেলা মদের নেশায় মাতালরা পাঁচবেলা খোদার দরবারে সিজদাকারী নামাজি বনে যায়। একে অপরের রক্তপিপাসুরা পরস্পর এমন ভাই ভাই হয়ে যায়, যার সামনে রক্ত সম্পর্কও তুচ্ছ মনে হয়। বিক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী জাতি এমনভাবে ঐক্যবদ্ধ হয় যেন শিশাগলিত প্রাচীর। তারা এক আল্লাহর বাণী প্রচার করাকেই নিজ জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং এ পথে নিজেদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ নির্দ্ধিধায় উৎসর্গ করে। আর এই উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে উত্তাল সমুদ্রও তাদের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারেনি এবং ভয়ানক মরুভূমিও তাদের উদ্যমে চির ধরাতে পারে নি।

এমনকি অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামের দিগ্বিজয়ী, চিরস্থায়ী, শান্তি ও নিরাপত্তা এবং সত্য ও খাঁটি তৌহিদের শিক্ষা এবং জীবন প্রদায়িনী খোদাপ্রেমের বাণী দ্বারা গোটা বিশ্বজগতকে প্রদীপ্ত করার জন্য এই তারা ‘কর্মের মূর্ত-প্রতীক’ হিসেবে সকল সমস্যাকে পায়ে ঠেলে সম্মুখে এগিয়েছে। সকল ক্ষেত্রে তারা বিজয় লাভ করেছিলেন।

ইসলামের অনুসারী মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অতি আশ্চর্যজনক সাফল্য লাভ ও সুমহান কীর্তি স্থাপন করে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এক অতি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। তাদের সে সাফল্য প্রকৃতই অতীব বিস্ময়কর।

মুসলমানেরা হয়েছিল বিশ্বের অর্ধেকের মালিক। তারা প্রবল প্রতাপ ও শানশওকতের সঙ্গে শাসন করেছে অর্ধজাহান। শৌর্য-বীর্য, জ্ঞানবিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রকৃতি সকল ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য ছিল অতীব চমকপ্রদ। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো জাতিই ছিল না তাদের সমকক্ষে দাঁড়াতে।

মুসলমানেরা বিশ্বে সকল ক্ষেত্রেই ছিল শীর্ষস্থানীয়, নেতৃস্থানীয়। যুদ্ধ হতে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হওয়ায় তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী।

সে যুগে মুসলমানেরাই দিয়েছিল বিশ্বনেতৃত্ব। অসাধারণ জাতিরূপে, শ্রেষ্ঠতম জাতিরূপে মুসলমানেরাই লাভ করেছিল প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ও খ্যাতি এতই অসাধারণ ছিল যে তারা আখ্যায়িত হয়েছেন বহু আলংকারিক বিশ্লেষণে, প্রশংসিত হয়েছেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বড় বড় মনীষীগণ কর্তৃক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় মুসলমানেরা উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল সত্য, তবে একথা বলাই বাহুল্য যে পরবর্তীকালে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরও এগিয়ে যেতে, নিজেদের সে প্রতাপ, প্রতিপত্তি, প্রাধান্য ও বিশ্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে তারা হয়েছিল ব্যর্থ। এর কারণ কী? শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে এবং অর্ধ জাহান শাসনের বিশ্বনেতৃত্ব যাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, তা আজ কোথায় গেল?

আজ এত এত মুসলমান দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন পারছে না মুসলমান বিশ্বনেতৃত্ব দান করতে? কেন পারছে না বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করতে? ফিলিস্তিনি মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে একজন মুসলমান হিসেবে আমরা কী করেছি? মুসলমানারা বিভিন্ন দেশে নির্যাতিত হচ্ছে অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না, এর মূল কারণ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার মতে মুসলিম জাতির আজ কোনো ঐশী নেতা নেই। যার কারণেই এক মুসলমান দেশ অন্য মুসলমান দেশের বিপদে পাশে দাঁড়াতে পারছে না।

মূলত যখনই ঐশী খেলাফতের রজ্জু থেকে মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তখন থেকেই তাদের উন্নতির ধারা বন্ধ হতে থাকে এবং বিশ্বময় অমুসলিমদের দ্বারা মার খাওয়া শুরু হয়।

তাই মুসলিম বিশ্বকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং পরস্পর বিভক্ত না হয়ে পবিত্র কুরআনের শিক্ষা এবং মহানবির (সা.) অতুলনীয় আদর্শের ওপর থেকে নিজ জীবন পরিচালনা করতে হবে।

সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করুন এবং ধর্মীয় বিভেদ দূর করে বিশ্বময় শান্তির সুবাতাস প্রবাহিত করুন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, ইসলামি চিন্তাবিদ।
[email protected]

এইচআর/এমএস

Read Entire Article