ওজন কমানো নিয়ে প্রচলিত কিছু মেডিকেল মিথ

2 weeks ago 11

ওজন কমানো নিয়ে আমাদের চারপাশে এত পরামর্শ, টিপস আর দ্রুত ফল পাওয়ার উপায় ঘোরাফেরা করে যে, কী বিশ্বাস করব আর কী করব না—তা বুঝে ওঠাই কঠিন। কারও মতে সকালে নাশতা না খেলে মেদ কমবে, কেউ বলেন নির্দিষ্ট কিছু খাবার খেলেই শরীরের চর্বি গলবে। আবার বাজারভরা সাপ্লিমেন্ট, লো-ফ্যাট খাবার বা নতুন নতুন ডায়েট ট্রেন্ড—সবই দাবি করে চমকপ্রদ ফলাফল।

আরও পড়ুন : ওজন কমাতে ৭ প্রচলিত ধারণা ভুলে গেলেই ফল আসবে আরও সহজে

কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে এদের কতটা সত্যি? আজকের লেখায় আমরা জানব ওজন কমানো নিয়ে প্রচলিত কিছু ভুল ধারণা আর কোন বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকা দরকার।

১. সকালের নাশতা বাদ দিলে ওজন কমে

বলা হয়ে থাকে সকালের নাশতা দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার। এটা সত্য হোক বা না হোক, নাশতা না খাওয়ার ফলে ওজন কমবে—এই ধারণা খুব সোজাসাপ্টা নয়।

অনেকেই ভাবেন, একবেলা খাবার না খেলে ক্যালরি কম খাওয়া হবে। কিন্তু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ছোটবেলা থেকে নাশতা বাদ দিয়ে এসেছে, তাদের কোমরের মাপ বেশি, ইনসুলিন লেভেল ও কোলেস্টেরলও বেশি ছিল।

একটি ছোট গবেষণায় দেখা যায়, নাশতা না খেলে দুপুরে অতিরিক্ত খাওয়া হয় না, কিন্তু সেটা রাতের খাবারের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। তাই এই বিষয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নাশতা না খাওয়ার সঙ্গে ওজন বেশি হওয়ার সম্পর্ক ছিল, যা মদপান বা অলস জীবনের চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলেছিল।

২. কিছু খাবার ফ্যাট বার্ন করে

অনেকে মনে করেন আনারস, আদা, রসুন, অ্যাভোকাডো, শিম, ব্রকলি, গ্রিন টি ইত্যাদি ফ্যাট বার্নিং খাবার। বাস্তবে এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুবই দুর্বল। এসব খাবার খেলে ওজন কমে—এমন দাবির পেছনে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই।

৩. ওজন কমানোর সাপ্লিমেন্ট কাজ করে

অনেক সাপ্লিমেন্টের দাবি, তারা শরীরের চর্বি কমাতে সাহায্য করে। বাস্তবে এসব পণ্যের অনেকগুলোই হয় অকার্যকর, নয়তো ক্ষতিকর।

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জানিয়েছে, অনেক সাপ্লিমেন্টে গোপনে এমন উপাদান থাকে, যা মূলত প্রেসক্রিপশনের ওষুধে ব্যবহৃত হয় বা মানুষের ওপর ঠিকমতো পরীক্ষা করা হয়নি।

৪. কম চর্বিযুক্ত খাবার মানেই ওজন কমানোয় সহায়ক

কম ফ্যাট খাবারে সত্যিই চর্বি কম থাকতে পারে। তবে অনেক সময় এসব খাবারে চর্বি কমিয়ে তার জায়গায় চিনি বা লবণ বেশি দেওয়া হয়। তাই লেবেল পড়ে নেওয়া জরুরি।

রিডিউসড ফ্যাট মানে কিন্তু লো ফ্যাট নয়—এটা শুধু বোঝায় যে, মূল ভার্সনের চেয়ে এতে কম ফ্যাট আছে।

৫. স্ন্যাক খাওয়া একদম চলবে না

অনেকে মনে করেন স্ন্যাক খাওয়া ডায়েট নষ্ট করে। কিন্তু সব সময় তা ঠিক নয়। কী ধরনের স্ন্যাক খাওয়া হচ্ছে, সেটাই আসল ব্যাপার।

উদাহরণস্বরূপ, একটি ফল বা কম ফ্যাট দই খেলে দুপুরে অতিরিক্ত খাওয়া এড়ানো যায়। তবে কেউ কেউ ক্ষুধার জন্য, আবার কেউ কেউ কেবল বোর হয়ে স্ন্যাক খায়।

একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্থূল ব্যক্তিরা বেশি স্ন্যাক খান, কিন্তু যদি তারা স্বাস্থ্যকর স্ন্যাক বেছে নেন, তবে ওজন কমানো সম্ভব হতে পারে।

আরও পড়ুন : ঘুম থেকে উঠে এই ৫ কাজে ওজন কমবে দ্রুত

অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, যারা সফলভাবে ওজন কমিয়ে সেটি ধরে রেখেছেন, তারা প্রতিদিন ২টি স্ন্যাক খেতেন—যা হয়তো ওজন ধরে রাখতে সাহায্য করেছিল।

৬. কিছু চিনি অন্য চিনি থেকে ভালো

অনেকে ভাবেন, মধু বা ম্যাপল সিরাপের মতো প্রাকৃতিক চিনি ভালো আর সাদা চিনি খারাপ। আসলে শরীর সব চিনি-ই একভাবে হজম করে। চিনি যেখান থেকেই আসুক, শরীর সেটিকে গ্লুকোজে ভেঙে ফেলে।

মূল কথা হলো- চিনি কম খাওয়া উচিত, সেটা যে কোনো ধরনেরই হোক।

৭. চিনি একেবারে বাদ দিতে হবে

চিনি ক্যালরিতে ভরপুর, ঠিক। তবে ওজন কমাতে গিয়ে একেবারে চিনি বাদ দিতে হবে—এমন না। সবকিছুর মতোই, এখানে মডারেশন বা পরিমিতি আসল চাবিকাঠি।

বিশেষ করে, যেসব খাবারে অতিরিক্ত চিনি যোগ করা হয়, সেগুলো এড়ানো ভালো।

৮. কৃত্রিম মিষ্টি খাবার ভালো বিকল্প

অনেকে চিনি কমাতে অ্যাসপার্টেম বা স্টেভিয়ার মতো কৃত্রিম মিষ্টি খান। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এগুলো দিয়ে ক্যালরি কমানো গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা ওজন বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত হতে পারে।

তবে সব গবেষণাই এই ফলাফল দেয়নি। এই বিষয়ে এখনো গবেষণা চলছে।

৯. শরীরের নির্দিষ্ট অংশের চর্বি কমানো যায়

অনেকে পেট বা থাইয়ের চর্বি কমাতে চায়। কিন্তু বাস্তবে, শরীরের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা থেকে চর্বি কমানো সম্ভব নয়। শরীর যেভাবে ওজন কমায়, সেটা পুরো শরীরজুড়ে হয়।

তবে সেই অংশের পেশি টোন করতে ব্যায়াম করলে দেখতেও ভালো লাগে।

১০. জনপ্রিয় ফ্যাড ডায়েটগুলো খুব ভালো কাজ করে

অনেক ডায়েট হঠাৎ জনপ্রিয় হয়, আবার হারিয়ে যায়। মার্কিন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিসিজ  কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বলেছে- এইসব ফ্যাড ডায়েট পুষ্টি কমিয়ে দেয়, শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে কাজ করে না।

ওজন কমানো সহজ কাজ নয়। আমাদের শরীর এমনভাবে তৈরি হয়েছে যে, খাবার পেলেই তা জমিয়ে রাখে। কিন্তু এখনকার সময়ে খাবার সহজলভ্য হওয়ায় শরীর আগের মতোই চর্বি জমিয়ে রাখে।

আরও পড়ুন : ভাত ছেড়ে দিলেই কি ওজন কমবে? যা বলছেন পুষ্টিবিদ

সাধারণভাবে, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ক্যালরি নিয়ন্ত্রণ করাই ওজন কমানোর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। তবে ডায়াবেটিস বা স্থূলতার মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা থাকলে, ওজন কমাতে যাওয়ার আগে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

যদি কোনো পদ্ধতি অত্যাশ্চর্য মনে হয়, তবে সেটা সম্ভবত বাস্তবসম্মত নয়। তাই সচেতন থাকুন।

সূত্র: মেডিকেল নিউজ টুডে

Read Entire Article