বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আট বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০১৭ সালের এদিনে নিজ দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা। গত দেড় বছরে ঢুকেছে আরও দেড় লাখের মতো। নতুন ও পুরোনো মিলে উখিয়া-টেকনাফে এখন ১৪ লাখের মতো রোহিঙ্গার বাস। গত আট বছরে কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়ার পরও মিয়ানমারের তালবাহানা, রোহিঙ্গাদের নানা শর্ত ও অজুহাতে আলোর মুখ দেখেনি প্রত্যাবাসন।
এর ওপর গত রমজানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জাতিসংঘের মহাসচিবের উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন আগামী ঈদ রোহিঙ্গারা নিজ ভিটায় গিয়ে উদযাপন করবেন। সেভাবেই কাজ চলছিল। কিন্তু এ ঘোষণার পর মিয়ানমার অভ্যন্তরে যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে আবারো শঙ্কায় পড়েছে ড. ইউনূসের ঘোষণা।
এমনই সংকট মুহূর্তে রোহিঙ্গা ঢলের ৮ বছর পূর্তিতে প্রত্যাবাসন স্বপ্ন নিয়ে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী রোহিঙ্গা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংলাপ।
রোববার (২৪ আগস্ট) বিকেল সোয়া ৫টায় উখিয়ার ইনানীর সেনা নিয়ন্ত্রিত হোটেল বে-ওয়াচের সম্মেলন কক্ষে সংলাপে প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
‘কনফিডেন্স বিল্ডিং ফর রিপ্যাট্রিয়েশন’ শীর্ষক আলোচনায় প্রত্যাবাসন বিষয়ে নিজেদের ভাবনা, ক্যাম্পের আশ্রিত জীবন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন সংলাপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা।
সম্প্রতি ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের ভোটে নির্বাচিত কমিউনিটি প্রতিনিধি খিন মংয় ও লাকি করিম ও উম্মে সালমার সঞ্চালনায় অধিবেশনে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, যুবাসহ রোহিঙ্গা প্রতিনিধিত্বশীলদের কণ্ঠে উঠে আসে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি।
রোহিঙ্গা ফটোগ্রাফার সাহাত জিয়া হিরো, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পাশে থাকায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের কথা তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এ দেশের জনগণের অবদান রোহিঙ্গারা চিরকাল মনে রাখবে।’
রোহিঙ্গা প্রতিনিধি মৌলভি সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘জাতিগত নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে আমরা অনিশ্চিত জীবনে বেঁচে আছি। মর্যাদা নিয়ে দ্রুত মাতৃভূমি মিয়ানমারের আরকানে ফিরতে চাই। এটা নিশ্চিতে বিশ্বকে আমাদের পাশে চাই। এভাবেই আমরা ঘরে ফিরতে পারি।’
রোহিঙ্গা প্রতিনিধির মধ্যে ফোরকান মির্জা, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, হুজ্জৌত উল্লাহ, আবদুল আমিন, আবদুল্লাহ, মুজিফ খান বক্তব্য রাখার পাশাপাশি প্রবাসী রোহিঙ্গারাও আলোচনায় অংশ নেন।
অধিবেশনে অংশ নেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান ও পররাষ্ট্র সচিব আসাদ আলম সিয়াম।
বিদেশি অতিথিদের মধ্যে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি টমাস এইচ. অ্যান্ড্রুজ, জাতিসংঘের বাংলাদেশে আবাসিক প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স, মিয়ানমারের জন্য স্বাধীন তদন্তকারী মেকানিজমের প্রধান নিকোলাস কুমজিয়ান এবং জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) অ্যাসিস্ট্যান্ট হাই কমিশনার রউফ মাজু এসময় উপস্থিত ছিলেন।
পাশাপাশি দেশের রাজনৈতিক দলের মাঝে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও গণঅধিকার পরিষদের প্রতিনিধিরা ছিলেন অধিবেশনে।
এছাড়া বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশন, জাতিসংঘের সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংগঠন, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, গণমাধ্যম, বিশেষজ্ঞ, সুশীল সমাজসহ শতাধিক রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন।
এই সংলাপকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে প্রথমবার আয়োজিত বড় সম্মেলন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে কীভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ উন্মুক্ত করা যায়, পাশাপাশি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্য নিয়ে এই সংলাপ আয়োজন করা হয়েছে।
জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ১০৭ দেশের অংশগ্রহণে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠাতব্য রোহিঙ্গা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনের প্রস্তুতি হিসেবে কক্সবাজার অনুষ্ঠেয় তিনদিনের আন্তর্জাতিক এ সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
সংস্থাটির যোগাযোগ কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির ওপর দৃষ্টি ধরে রাখার এবং সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্য যেকোনো প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। সংকটের সমাধান মিয়ানমারে নিহিত এবং রোহিঙ্গারা যখন পরিস্থিতি অনুকূল হবে তখন স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার এবং মাঠ পর্যায়ের মানবিক অংশীদারদের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর কাজ করে যাচ্ছে। এর লক্ষ্য হলো, প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং প্রায় সোয়া মিলিয়ন রোহিঙ্গা আশ্রিতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ, দীর্ঘমেয়াদী সমাধান খুঁজে বের করা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রোহিঙ্গা সমস্যা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভের দপ্তরের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সম্মেলনটির দেশি-বিদেশি অংশগ্রহণকারীরা শেষ দিন ২৬ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাবেন বলে জানিয়েছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়। যেকোনো মূল্যে বিশ্ব নেতৃত্বের সহযোগিতায় রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনই মূল লক্ষ্য হিসেবে ভাবছে সরকার।
এফএ/এমএস