কর্তৃত্ববাদী বস নয়, প্রকৃত নেতা প্রয়োজন

3 hours ago 5

আমরা এমন এক সমাজে বাস করি যেখানে প্রায়ই "বস" বা "কর্তা" শব্দটি নেতৃত্বের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বস আর নেতা—এই দুইয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একজন বস শুধু নির্দেশ দেন, ক্ষমতার জোরে কাজ করিয়ে নেন। আর একজন নেতা মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন, পথ দেখান, তাদের ভেতরের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন। আজকের বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজে, আমাদের দরকার আর কোনো কর্তৃত্ববাদী বস নয়—আমাদের দরকার প্রকৃত নেতাদের।

আমেরিকার বিখ্যাত নেতৃত্ব বিশেষজ্ঞ জন সি. ম্যাক্সওয়েল নেতৃত্বের ৫টি স্তরকে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কীভাবে একজন মানুষ ধাপে ধাপে একজন বস থেকে প্রকৃত নেতা হয়ে উঠতে পারেন। তাঁর এই ফ্রেমওয়ার্ক আমাদের সমাজ ও কর্মক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিতে পারে।

নেতৃত্বের প্রথম স্তর: পজিশন (Position)

ম্যাক্সওয়েলের মতে নেতৃত্বের প্রথম ধাপ হলো "পজিশন"। এখানে মানুষ নেতৃত্ব দেয় কেবল পদমর্যাদার কারণে। যেমন—একজন ম্যানেজার, চেয়ারম্যান বা অফিসার পদে বসে আছেন, তাই তাঁর অধীনে অন্যরা কাজ করে। কিন্তু এই ধাপটি সবচেয়ে দুর্বল স্তর। কারণ এখানে অনুসারীরা বাধ্য হয়ে অনুসরণ করে, স্বেচ্ছায় নয়।

প্রখ্যাত বক্তা জিম রন একবার বলেছিলেন—"You don’t get paid for the hour. You get paid for the value you bring to that hour." অর্থাৎ পদ বা সময় নয়, আসল মূল্য হলো অবদান। তাই কেবল পদ দিয়ে নয়, মানুষের জীবনে মূল্য সংযোজন করেই প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। আমাদের সমাজে বহু প্রতিষ্ঠান এখনো এই প্রথম স্তরে আটকে আছে, যেখানে নেতৃত্ব মানে শুধু আদেশ দেওয়া। অথচ এভাবে দীর্ঘমেয়াদে কোনো উন্নতি সম্ভব নয়।

নেতৃত্বের দ্বিতীয় স্তর: অনুমতি (Permission)

যখন নেতা অনুসারীদের সম্মান অর্জন করেন এবং তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন, তখন তিনি "অনুমতি" স্তরে পৌঁছান। এখানে অনুসারীরা কাজ করে শুধু পদমর্যাদার কারণে নয়, বরং তারা নেতাকে পছন্দ করে, তার প্রতি আস্থা রাখে।
আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন—“If you would win a man to your cause, first convince him that you are his sincere friend.” একজন নেতাকে সবার আগে মানুষের বন্ধু হতে হবে। মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা অর্জন করলে নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি দেখি, একজন জনপ্রিয় শিক্ষক বা একজন সমাজকর্মী অনেক সময় পদমর্যাদা ছাড়াই চারপাশে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, কারণ মানুষ তাদের বিশ্বাস করে। এটিই অনুমতি স্তরের নেতৃত্ব।

নেতৃত্বের তৃতীয় স্তর: প্রোডাকশন (Production)

ম্যাক্সওয়েলের মতে, এই স্তরে নেতা ফলাফল দেখাতে শুরু করেন। তিনি নিজে শুধু নেতৃত্ব দেন না, বরং প্রতিষ্ঠান বা সমাজে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটান। ফলাফলই অনুসারীদের আস্থা আরও বাড়ায়।

বাংলাদেশের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের শুধু বস নয়, প্রকৃত নেতা তৈরি করতে হবে। জন সি. ম্যাক্সওয়েলের ৫টি স্তর আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে একজন নেতা ধাপে ধাপে উন্নতি করতে পারেন। আর ব্রায়ান ট্রেসি, জিম রন, টনি রবিনস, লিংকন, গান্ধীর মতো মহৎ চিন্তাবিদরা আমাদের শেখান—নেতৃত্ব মানে প্রভাব সৃষ্টি, মানুষকে অনুপ্রাণিত করা, এবং তাদের উন্নত জীবন যাপনের পথে এগিয়ে নেওয়া।

প্রখ্যাত লেখক ও কন্সাল্টেন্ট ব্রায়ান ট্রেসি প্রায়ই বলেন—“Leaders are never satisfied; they continually strive to be better.” একজন নেতা যখন দৃশ্যমান উন্নতি ঘটাতে থাকেন, তখন তার অনুসারীরা অনুপ্রাণিত হয় এবং সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়।
এই স্তরে নেতৃত্ব আর কেবল সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না, বরং কাজের ফলাফল দিয়ে পরিমাপ করা হয়। যেমন একজন উদ্যোক্তা যিনি শুধু ব্যবসা চালাচ্ছেন না, বরং কর্মসংস্থান তৈরি করছেন—তাকে মানুষ প্রকৃত নেতা হিসেবেই দেখে।

নেতৃত্বের চতুর্থ স্তর: মানুষ উন্নয়ন (People Development)

প্রকৃত নেতৃত্বের আসল সৌন্দর্য এই স্তরে প্রকাশ পায়। এখানে নেতা আর শুধু নিজেকে নয়, বরং অন্যদের গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দেন। তিনি নতুন নেতৃত্ব তৈরি করেন, দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন, তাদের সম্ভাবনা কাজে লাগান।

বিখ্যাত লেখক ও মোটিভেটর টনি রবিনস বলেছেন—“Leaders spend 5% of their time on the problem and 95% of their time on the solution.” একজন প্রকৃত নেতা কেবল নিজের সাফল্যে খুশি হন না; বরং তিনি অন্যদের সাফল্যে বিনিয়োগ করেন।
আমাদের সমাজে যদি আমরা সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন চাই, তাহলে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি সংগঠন, এমনকি পরিবারকেও এই স্তরের নেতৃত্বে যেতে হবে। বাবা-মা সন্তানকে শুধু শাসন না করে, বরং তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরি করে দিতে পারলেই ভবিষ্যতে দেশ এগিয়ে যাবে।

নেতৃত্বের পঞ্চম স্তর: শীর্ষ (Pinnacle)

এটি নেতৃত্বের সর্বোচ্চ ধাপ। এখানে একজন নেতা কেবল নিজের প্রতিষ্ঠান বা সম্প্রদায়কে নয়, বরং সমগ্র সমাজকে অনুপ্রাণিত করেন। এই স্তরে পৌঁছে তিনি নিজেই একটি প্রতীকে পরিণত হন।

মহাত্মা গান্ধী ছিলেন এমন একজন নেতা। তাঁর কোনো পদ ছিল না, কোনো সরকারি ক্ষমতা ছিল না, কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব, নৈতিক শক্তি এবং অহিংস আন্দোলন ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। গান্ধী প্রমাণ করেছিলেন—পদ নয়, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও নৈতিক দৃঢ়তাই প্রকৃত নেতৃত্বের ভিত্তি।

একইভাবে আব্রাহাম লিংকন দাসপ্রথা বিলুপ্ত করে মার্কিন সমাজকে চিরতরে বদলে দিয়েছিলেন। আজও তারা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে আছেন।

কেন আমাদের সমাজে কর্তৃত্ববাদী বস নয়, নেতার প্রয়োজন

একজন বস হয়তো কাজ করিয়ে নিতে পারেন, কিন্তু তিনি মানুষের হৃদয় জয় করতে পারেন না। অথচ একজন প্রকৃত নেতা মানুষকে স্বপ্ন দেখান, তাদের সম্ভাবনা উন্মোচন করেন, সমাজকে এগিয়ে নেন। আমাদের অফিস, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান—সব জায়গায় নেতার প্রয়োজন, যারা সম্পর্ক গড়বে, ফলাফল আনবে, নতুন প্রজন্মকে তৈরি করবে।

জিম রন বলেন—“The challenge of leadership is to be strong, but not rude; be kind, but not weak; be bold, but not a bully.” আমাদের সমাজে যদি নেতারা এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন, তবে সত্যিকারের উন্নয়ন ঘটবে।

বাংলাদেশের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে আমাদের শুধু বস নয়, প্রকৃত নেতা তৈরি করতে হবে। জন সি. ম্যাক্সওয়েলের ৫টি স্তর আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কীভাবে একজন নেতা ধাপে ধাপে উন্নতি করতে পারেন। আর ব্রায়ান ট্রেসি, জিম রন, টনি রবিনস, লিংকন, গান্ধীর মতো মহৎ চিন্তাবিদরা আমাদের শেখান—নেতৃত্ব মানে প্রভাব সৃষ্টি, মানুষকে অনুপ্রাণিত করা, এবং তাদের উন্নত জীবন যাপনের পথে এগিয়ে নেওয়া।
আজ সময় এসেছে আমাদের নেতৃত্বের সংস্কৃতি বদলে ফেলার। পদমর্যাদার দম্ভ নয়, দরকার প্রভাবশালী নেতৃত্ব। বস নয়, নেতা চাই—সবখানে, প্রতিটি স্তরে।

লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট ও আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না” বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।

এইচআর/এমএস

Read Entire Article