কাগজপত্র জালিয়াতি করে অধ্যক্ষ হয়েছেন জাকির হোসেন

4 hours ago 2

বগুড়ার শেরপুর টাউনক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা অনার্স কলেজে অধ্যক্ষ নিয়োগকে কেন্দ্র করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগের পর এবার নতুন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী কর্মস্থলের কাগজপত্র জালিয়াতির মতো গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।

সভাপতির স্বাক্ষর জালিয়াতি করে পদত্যাগপত্র তৈরি, শিক্ষকদের ভুয়া স্বাক্ষর ব্যবহার এবং কর্মস্থল ত্যাগ না করেই নতুন কলেজে যোগদানসহ একাধিক অভিযোগ ওঠায় তোলপাড় চলছে শিক্ষা মহলে।

গত ৩ মে নিয়োগ পরীক্ষার দিনই কলেজের গভর্নিং বডির দুই সদস্য, বিদ্যোৎসাহী সদস্য পিয়ার হোসেন পিয়ার এবং দাতা সদস্য জাহিদুর রহমান টুলু অভিযোগ তোলেন প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বিনিময়ে মোহাম্মদ জাকির হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পরে তারা গত ৭ মে জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

পরবর্তীতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে গত ২১ আগস্ট বগুড়া জেলা শিক্ষা অফিসার রমজান আলী আকন্দ এই অভিযোগের তদন্তে কলেজে যান।

আর্থিক লেনদেনের অভিযোগের মধ্যেই জাকির হোসেন গত ১৯ মে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। এরপরই তার বিরুদ্ধে পূর্ববর্তী কর্মস্থল, সিরাজগঞ্জের সায়দাবাদে যমুনা ডিগ্রি কলেজের কাগজপত্র জালিয়াতির অভিযোগ সামনে আসে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জাকির হোসেন সিরাজগঞ্জের সায়দাবাদের সারটিয়ায় যমুনা ডিগ্রি কলেজের উপাধ্যক্ষ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকে যথাযথভাবে পদত্যাগ না করেই তিনি শেরপুরের কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিনি কয়েকটি ধাপে জালিয়াতির আশ্রয় নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

যমুনা ডিগ্রি কলেজের মুভমেন্ট রেজিস্টারে পারিবারিক কারণ দেখিয়ে গত ১৮ মে থেকে মাত্র তিন দিনের ছুটির কথা উল্লেখ করেন জাকির হোসেন। এরপর থেকে তিনি সেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

তিনি যমুনা ডিগ্রি কলেজের সভাপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে একটি কাগজ দেখান, যেখানে সভাপতির স্বাক্ষর ও সিলমোহর রয়েছে।

কিন্তু যমুনা ডিগ্রি কলেজের সভাপতি শাহাদৎ হোসেন বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করে বলেন, তার কথিত পদত্যাগ জমা নেওয়া এবং সম্মতিপত্র বা স্বাক্ষর দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জাকির সাহেব বিশ্বাসের অমর্যাদা করে আমার স্বাক্ষর জাল করেছেন।

অন্যদিকে, নতুন কলেজে নিয়োগ ও বেতন-ভাতার জন্য পূর্ববর্তী কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের স্বাক্ষরসহ স্টাফ প্যাটার্ন জমা দেওয়া আবশ্যক। অভিযোগ, জাকির হোসেন সেই প্যাটার্ণেও সব শিক্ষক-কর্মচারীর স্বাক্ষর জাল করেছেন।

এ ছাড়াও উপাধ্যক্ষ থাকাকালীন কলেজের মোবাইল ফোন, পাসওয়ার্ড, চেক বই, রেজিস্ট্রার বইসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নথি তিনি বর্তমান কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

যমুনা ডিগ্রি কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আব্দুল আওয়াল জানিয়েছেন, জাকির হোসেনের দীর্ঘ অনুপস্থিতি, গুরুত্বপূর্ণ নথি হস্তান্তর না করা এবং জালিয়াতির কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার (মাউশি) রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।

তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, তার নতুন চাকরির খবর আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেয়েছি। কিন্তু তিনি যে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নেবেন, তা ছিল কল্পনার বাইরে।

তবে এসব অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন শেরপুর টাউনক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা ডিগ্রি কলেজের নতুন অধ্যক্ষ মোহাম্মদ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, আমি যথাযথ নিয়ম মেনেই আমার পূর্ববর্তী প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ করেছি এবং নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেছি। একটি মহল আমার সম্মানহানি করার জন্য এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।

এ বিষয়ে শেরপুর টাউনক্লাব পাবলিক লাইব্রেরি মহিলা অনার্স কলেজের সভাপতি কেএম মাহবুবার রহমান হারেজ কালবেলাকে বলেন, নিয়োগের সময় আমরা সব কাগজপত্র যাচাইবাছাই করেই অধ্যক্ষ নিয়োগ দিয়েছি। আমাদের কাছে জমাকৃত সব নথি বৈধ মনে হয়েছিল। এখন যেহেতু তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছে, তাই তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বগুড়া জেলা শিক্ষা অফিসার রমজান আলী আকন্দ কালবেলাকে জানান, আমরা অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করেছি। অভিযোগ প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা কালবেলাকে জানান, তার উদ্দেশ্য— সব জায়গায় স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, যেখানে কোনো প্রকার দুর্নীতি বা স্বজনপ্রীতি থাকবে না। 

তিনি উল্লেখ করেন, তার প্রতিনিধিরা যেখানে নিয়োগ প্রক্রিয়া চলে, সেখানে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেন। 

জেলা প্রশাসক জানান, তদন্ত রিপোর্ট এখনও তার হাতে পৌঁছায়নি। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে আসার পর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Read Entire Article