যমুনা নদীর তীর ঘেঁষে সিরাজগঞ্জে গড়ে উঠছে দেশের বৃহত্তম শিল্পপার্ক। ৪০০ একর জায়গার ওপর এ শিল্পপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন না করেই প্লট হস্তান্তর করায় বিপাকে পড়েছেন শিল্প উদ্যোক্তারা। বেশির ভাগ প্লটেই যথাযথ মাটি ভরাট না করায় শিল্প স্থাপনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। এতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দায়ী করছেন প্লট বরাদ্দ পাওয়া উদ্যোক্তারা।
প্লট বরাদ্দ নীতিমালা অনুসারে ভূমি উন্নয়ন, মাটি ভরাট, গ্যাস, বিদ্যুতের সঞ্চালন, পানি নিষ্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করেই প্লট বরাদ্দ দেবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। কিন্তু প্রকল্পে সঠিকভাবে প্লটগুলোতে মাটি ভরাট না করা, অসমাপ্ত অবকাঠামো, নিম্নমানের রাস্তা ও ড্রেন নির্মাণসহ ও নানা অনিয়মের কারণে শিল্প স্থাপন যেন দুয়ারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কয়েক দফায় ব্যয় বাড়িয়ে ৭১৯ কোটি ২১ লাখ টাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক)। প্রকল্পের এ ক্যাটাগরির প্লট ২০ হাজার, বি ক্যাটাগরির প্লট ১০ হাজার ও এস ক্যাটাগরির প্লট ৬ থেকে ২৬ হাজার বর্গফুট আয়তনের ৮২৯টি প্লট তৈরি করে ৫৭০টি শিল্প স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়। এরমধ্যে ৫৫০টি প্লট বিদেশি বিনিয়োগকারী ও দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য ১৯২টি প্লট ৭৯টি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বাকি ৮৭টি প্লটের বিপরীতে আরও ৫৩টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছেন। কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বেশির ভাগ প্লটেই এখনও মাটি ভরাট করা হয়নি। গড়ে প্রায় ৫-৮ ফুট পরিমাণ গভীর রয়েছে। ড্রেনেজ, পানি ও গ্যাস সংযোগ কাজও অসম্পূর্ণ। ফলে প্লট হাতে পেয়েও শিল্প কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করতে ঝুঁকির আশঙ্কা করছেন তারা। এতে পতিত পড়ে রয়েছে হাজার কোটি টাকা মূল্যের প্লট। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্বপ্নবাজ উদ্যোক্তারা।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেশীয় ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে বরাদ্দ দেওয়া ১৯২টি প্লট গড়ে প্রায় ৫-৮ ফুট পরিমাণ গভীর রয়েছে। আবার বেশ কিছু স্থানে ড্রেন ও রাস্তার কাজ অসম্পূর্ণ। বৃষ্টির পর পানি জমে তৈরি হয়েছে বড়বড় গর্ত। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগও সম্পন্ন হয়নি।
যমুনা পেপার অ্যান্ড বোর্ড ফ্যাক্টরির স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ১০ হাজার বর্গ ফুটের চারটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছি। প্রথমবারের মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানের জায়গা বরাদ্দ পেয়ে বেশ আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু এ প্লটগুলো একদম অসম্পূর্ণ। প্লটগুলো ৮-১২ ফুট পর্যন্ত গভীর। এ অবস্থায় আমরা কীভাবে শিল্প স্থাপন করব। ওইদিকে বিসিকের কর্মকর্তারা তো প্লট বরাদ্দ দিয়েই দায় সাড়া।’
উদ্যোক্তা সিরাজুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিসিক আমাদের প্লটের বদলে পুকুর দিয়েছেন। হয়তো ভুলবশত পুকুরের জায়গায় প্লট লিখে ফেলেছেন। এখানে মাছ চাষ করা সম্ভব, ফ্যাক্টরি নয়।’
আরও পড়ুন
শিল্পে কাঁচামাল সংকট, রমজানে নিত্যপণ্য সরবরাহে বিঘ্নের আশঙ্কা
গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে বিপর্যস্ত শিল্প মালিকরা
শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত চান ব্যবসায়ীরা
যমুনা ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক ইকবাল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ৫৫০টি প্লট সম্পূর্ণ হলেও আমরা যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের প্রত্যেকটি প্লট অসম্পূর্ণ রেখেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমরা বারবার শিল্প পার্কের কর্মকর্তাদের কাছে গিয়েও কোনো সমাধান পাইনি। তারা বলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বিল নিয়ে চলে গেছে। এখন আপনারা মাটি ভরাট করে নেন। অথচ কাজ ঠিকভাবে বুঝে না নিয়েই তারা ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করেছেন।’
গোল্ডেন প্রিমিয়াম ওয়েল মিলসের মালিক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যে প্লট আমাদের দেওয়া হয়েছে, সেটা রাস্তার চেয়ে ৫-৬ ফুট নিচে। প্রায় ৫ লাখ সিএফটি বালু কম দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় শিল্প কারখানা স্থাপন কোনোভাবে সম্ভব হবে না।’
আব্দুর রাজ্জাক নামের এক উদ্যোক্তা অভিযোগ করে বলেন, ‘এ শিল্প পার্কে অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে এখানে বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছি। তবে যারা এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করেন তিনি।’
নওগাঁর জিলানী ওয়েল মিলের ব্যবস্থাপক আতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা ছয়টি প্লট বরাদ্দ পেয়েছি। প্লটগুলোতে মাটি ভরাট অসম্পূর্ণ। তবে বিসিক কর্মকর্তা ও শিল্পপার্ক মালিক সমিতির সভাপতির পরামর্শে নিজ খরচে মাটি ভরাট করতে বাধ্য হয়েছি। তারা অবশ্য আশ্বস্ত করেছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা জামানত থেকে এই খরচ বহন করা হবে।’

সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্ক মালিক সমিতির সভাপতি ও সবুজ ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্বাধিকারী আব্দুল কাদের শেখ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের শুরুতে ২৭ কোটি ঘন ফুট মাটি ভরাটের জন্য ১৭৪ কোটি টাকা বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নারায়ণগঞ্জ সিপিয়ার্ডের সঙ্গে চুক্তি হয়। পরে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ১৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা আটকে রাখা (রিটেনশন মানি) শর্তে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড কাজ নেন। কিন্তু তারা কাজ সম্পন্ন করেনি। পরে বিসিকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে কোনো সাড়া না পেয়ে আমি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারা আমায় দায়িত্ব নিয়ে অসম্পূর্ণ কিছু প্লটের মাটি ভরাটের কাজ করে দিতে বলেন।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী লেফট্যানেন্ট কর্নেল (অবসর প্রাপ্ত) জিয়াউল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমরা যথাযথভাবে ওই শিল্পপার্কের মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন করেছি। এখন আবার নতুন করে মাটি ভরাট করে দেওয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই।’
সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্কের উপ-ব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহবুবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি নতুন এ দায়িত্ব পেয়েছি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের রিটেনশন মানি এখনও ফেরত দেওয়া হয়নি। মালিক সমিতির সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সভাপতি ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান বাচ্চু বলেন, ‘নৌ, রেল ও সড়ক পথের সুবিধা থাকায় এ শিল্পপার্ক হতে পারে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্পাঞ্চল। এখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশাল সুযোগ রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নানান অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এবিষয় গুলো শিল্প মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
এ প্রসঙ্গে সিরাজগঞ্জ বিসিক শিল্পপার্কের প্লট বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শিল্পপার্কের অসম্পূর্ণ প্লট বরাদ্দ পাওয়ার বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোক্তা আমার কাছে অভিযোগ করেননি। তবে এমনটি হয়ে থাকলে অবশ্যই খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এম এ মালেক/আরএইচ/জিকেএস

2 hours ago
4









English (US) ·