কাজী নজরুল ইসলামের প্রবন্ধে শিক্ষাভাবনা

18 hours ago 5

ফারজানা অনন্যা

একটি দেশের কোনো কবিকে জাতীয় কবির মর্যাদায় অভিষিক্ত করার সাথে উক্ত জাতির রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক বিবর্তনের একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে। কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আমাদের বাঙালি জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য পর্যালোচনা করলে যে ঘটনা বা শব্দ বারবার আমাদের ঐতিহাসিক অভিধানকোষে ধরা পড়ে, তা হলো ‘বিদ্রোহ’। সেই বিদ্রোহ অন্যায় ও জুলুমবাজীর কাছে মাথা নত না করার বিদ্রোহ। কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্যের মূলসুরও সেই ‘উন্নত মম শির’। নজরুলের বিদ্রোহ ছিল অন্যায়, অসাম্য আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। নজরুলের বিদ্রোহের মূলে স্বভাবগত অকৃত্রিম মানব প্রেম এবং সে প্রেমের প্রকাশ তাঁর অন্তরের সাম্যবাদের নির্দেশানুসারে। শুধু স্বদেশেই নয়, বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি একাত্মতা অনুভব করেন বলেই তাঁর সাম্যবাদী কবি-চিত্ত মানুষের নির্যাতন, লাঞ্ছনা, শোষণ প্রভৃতি উচ্ছেদ করতে বিদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন- শিক্ষা ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক স্বাধীনতায়, অধিকারে, অর্থনীতিতে, ধর্মে কিংবা নারী-পুরুষের ভেদাভেদহীনতায়। কেবল কবি হিসেবে নন; বরং গীতিকার, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার কিংবা সম্পাদক হিসেবেও তিনি সমকালীন পরাধীন ভারতবর্ষে সর্বস্তরে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়া অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। লড়াই করেছেন শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, বৈষম্যের মুখোমুখি তাঁর তলোয়ারসম শাণিত শব্দগুচ্ছ দ্বারা।

কবিতা ও গানের তুলনায় নজরুলের প্রবন্ধের সংখ্যা নগণ্য হলেও প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর পরিচয় জ্বলে ওঠা বারুদের শিখার মতোই তেজোদ্দীপ্ত। প্রাবন্ধিক নজরুলের বিকাশ ঘটে সাংবাদিক হওয়ার পর। সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ (১৯২০), অর্ধ সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’ (১৯২২), সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫-২৬) এবং সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’তে (১৯২৬) সমকালীন দেশকাল ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের ঘটনাবলি নিয়ে প্রকাশিত নজরুলের রচনা বা নিবন্ধে। মূলত নজরুলের প্রবন্ধগুলো নবযুগ, ধূমকেতু ও লাঙল পত্রিকায় সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে এগুলো সামান্য পরিমার্জন করে ‘যুগবাণী’ (১৯২২), ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ (১৯২৩), ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬) ও ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রাবন্ধিক নজরুলের লেখনীতে তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, বিশেষত শিক্ষা-চিন্তামূলক ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। সমকালীন দেশ, সমাজ ও পরিবেশকে প্রত্যক্ষ করার যে দর্পণ নজরুল তাঁর প্রবন্ধে সংস্থাপন করেছিলেন, তাতে দেশমাতৃকার দেহাবয়বের শিক্ষা অঙ্গটি বেশ স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাভাবনার সমসাময়িক শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাচিন্তকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া। পরবর্তীতে কাজী আবদুল ওদুদের লেখনীতেও আমরা ভারতীয় বাঙালিদের শিক্ষাসংস্কার সম্পর্কে তাঁদের মূল্যবান অভিমত পাই। তবে সকলের মধ্য নজরুল তাঁর আপন চিন্তায় ছিলেন ব্যতিক্রমী এবং দারুণ স্পষ্টবাদী। কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাভাবনার মূলসূত্র ছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাবে উদীয়মান দেশীয় ‘শিক্ষা আন্দোলন’। নজরুল তাঁর শিক্ষাচিন্তামূলক নিবন্ধগুলোতে সরাসরি ব্রিটিশ আদলে গড়া ভারতীয় শিক্ষার বিরোধিতা করেছেন। এমনকি ‘জাতীয় শিক্ষা’ ও ‘সত্য শিক্ষা’ প্রবন্ধদ্বয়ে সমকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষাকার্যক্রমকে ব্রিটিশদের অন্ধ অনুকরণ ও হাস্যাস্পদ ‘হনুকরণ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তীব্র ব্যঙ্গ ও প্রতিবাদ মুখরিত ভাষায় তিনি তাঁর প্রবন্ধসমূহে সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো নির্দেশ করে সমাধানের পথ দেখিয়েছেন। যা বর্তমান সময়েও শিক্ষাঙ্গনের সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও তা সমাধানের জন্য সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।

কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাভাবনা সবথেকে বেশি স্পষ্টরূপে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর ‘যুগবাণী’ প্রবন্ধগ্রন্থের ‘ভাব ও কাজ’, ‘সত্য শিক্ষা’, ‘জাতীয় শিক্ষা’ এবং ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধ চারটিতে। যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালে। স্মতর্ব্য যে, বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ রাজ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। শিশির করের ‘নিষিদ্ধ নজরুল’ গ্রন্থের প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি সরকারি ফাইল থেকে বইটিকে বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। তার একটি নমুনা:
‘I have examined the book ‘Yougani’. It breathes bitter racial hatred directed mainly against the existing administration in the country and abuses in the very strong language the ‘slave- minded’ Indians who upholds the administration. The three articles on ‘Memorial to Dyer’, who was responsible for the Muslims massacre?’ and shooting the black-men are specially objectionable. I don’t think it would be advisable to remove the ban this book in the present crisis. On the whole it is a dangerous book forceful and vindictive.’ [Sd/-illegible, date :16.1.41, File No -58-31/40 Home (Pol)]
ব্রিটিশ আমলে যুগবাণী কতটা ত্রাস ছড়িয়েছিল ব্রিটিশদের ঘুণে ধরা মনে, তা উপরের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান। এই ত্রাসের বাণী ছিল শিক্ষাঙ্গন নিয়েও। কারণ নজরুল জানতেন মেদা মার্কা শিক্ষার্থী যুবকরা মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারলেই পরাধীন দেশে বিপ্লব সম্ভব।

কাজী নজরুল ইসলামের যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থের প্রবন্ধ চতুষ্টয়ে সমকালীন শিক্ষাঙ্গনের যেসব বিষয় প্রতিফলিত হয়েছে, মোটা দাগে সেগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
ক. শিক্ষাপদ্ধতিতে বিদেশি অনুকরণের তিরস্কার করেছেন
খ. শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির উল্লেখ (কাঁচা অধ্যাপক নিয়োগ প্রসঙ্গ)
গ. শিক্ষার্থীদের আবেগকে ভুল কাজে ব্যবহার সম্পর্কে অভিমত
ঘ. মুখস্থ বিদ্যার বিরুদ্ধাচারণ এবং
ঙ. শিক্ষার্থীদের মানসিক উজ্জীবনের স্বপক্ষে বিবৃতি।
দমননীতি, শিক্ষাপদ্ধতিতে বিদেশি পদ্ধতির অনুসরণ, শিক্ষার্থীদের আবেগকে ভুল কাজে ব্যবহার, শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, মুখস্থ বিদ্যার বিরুদ্ধাচারণ ইত্যাদি সম্পর্কে নির্ভীক লেখনীতে দুর্বিনীতভাবে সত্য উচ্চারণ করেছেন। নজরুলের সেসব বাণী বর্তমান অস্থির ও রুগ্ন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাই বলা যায়, শিক্ষা সম্পর্কিত নজরুলের ভাবনা ধ্রুপদী ও চিরকালীন।

আরও পড়ুন

‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধটিতে শিক্ষার মতো পবিত্র বিষয়টিকে আমরা যাতে স্বার্থসিদ্ধির সামান্যতা দিয়ে কলঙ্কিত না করি, সে অনুরোধ রেখেছেন। জাতীয় বিদ্যাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে ‘কাঁচা অধ্যাপক’ নিয়োগ নিয়ে তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। তারা বয়সে কাঁচা নন বরং বিদ্যায় কাঁচা। প্রবন্ধটি লেখার প্রায় একশ দুই বছর পরেও আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিতে দেখি। ‘যে সব অধ্যাপক গোলামখানা ছাড়িয়া আমাদের বহবা লইয়াছেন, তাঁহাদিগকেই যে জাতীয় বিদ্যালয়ের অধ্যাপক করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই।’ ওই সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার সরাসরি বিরোধিতা করে যেসব শিক্ষক দেশীয় শিক্ষা প্রচলনের পথে ছিলেন, তাঁদের গণহারে জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধ্যাপক পদে বহাল করার বিরোধিতা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে থাকেন স্বার্থহীনভাবে নন, নৈতিকতা, মূল্যবোধের তাড়নায় নন বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তাঁরা যোগ্য না হয়েও প্রতিপক্ষের প্রতি জনরোষকে পুঁজি করে কোনো কোনো পদে বসে যান এবং অবাধে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেন। শিক্ষাক্ষেত্রে মিথ্যা এবং ক্ষমতার অমঙ্গলকে প্রবেশ করতে না দেওয়ারও শপথবাণী পাওয়া যায় এ প্রবন্ধে। কর্মক্ষেত্রে তিনি স্বজনপ্রীতির চাইতে যোগ্যতমকে স্থান দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ‘বন্ধুর মর্যাদার চাইতে সত্যের মর্যাদা অনেক উপরে।’ এই পঙ্ক্তি দ্বারা তিনি কর্মক্ষেত্রে অসত্য, স্বজনপ্রীতি ও পক্ষপাতদুষ্টতাকে এক কথায় ঘৃণিত কাজ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রাবন্ধিক নজরুল চেয়েছেন, যেখানে বিদ্যার্থীর জীবনীশক্তি সজাগ ও জীবন্ত হয়ে উঠবে। নজরুলের ভাষায়, ‘যে-শিক্ষা ছেলেদের দেহ-মন দুইকেই পুষ্ট করে, তাহাই হইবে আমাদের শিক্ষা। ‘মেদা-মারা’ ছেলের চেয়ে সে হিসাবে ডানপিটে ছেলে বরং অনেক ভালো।’ তারুণ্যশক্তির আরাধনা করেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের প্রাণশক্তি ও কর্মশক্তিকে যাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জাতীয় শিক্ষা একত্রীভূত করে শক্তিশালী ও কার্যকর করে তুলতে পারে-এ প্রত্যাশাই কাজী নজরুল ইসলাম এ প্রবন্ধে ব্যক্ত করেছেন।

‘জাতীয় শিক্ষা’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘অনুকরণ-প্রবণতা’ নয় বরং মৌলিক চিন্তাসৃষ্টির প্রণোদনার কথা লিখেছেন। ওই সময়ে বঙ্গদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত হয়ে প্রাচ্যশিক্ষার কথা বললেও আদতে তারা ‘টকের ভয়ে পালিয়ে গিয়ে তেঁতুলতলায় বাসা’ বাঁধারই উপক্রম করেছিল। পরিবর্তন এসেছিল শুধু নামে। যেন অনেকটা ‘বিলাতি শিক্ষার ট্রেডমার্ক উঠাইয়া স্বদেশী মার্কা লাগাইয়া দেওয়ার মতো।’ এসব ‘হনুকরণ’ প্রবণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নজরুল কিছুতেই স্বদেশি বা জাতীয় শিক্ষা বলে মানতে রাজি ছিলেন না। নজরুলের মতে, ‘এসবই ইংরেজি কায়দা-কানুনকে যেন মাথায় পগ্গ ও পায়ে নাগরা জুতা পরাইয়া এদেশি করা; অথবা সাহেবকে ধুতি ও মেমকে শাড়ি পরাইয়া বাবু ও বিবি সাজানো গোছ।’ আমরা কেবল অন্য সংস্কৃতিকে কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীদের মননে মনের অজান্তে বপণ করে তাদের সহিংস করে তুলছি আমাদের শেকড় ও আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নজরুলের প্রবন্ধের বার্তার জেরেই অস্বীকার করার উপায় নেই আমাদের। নজরুলের ভাষায়, ‘সত্যকে অস্বীকার করিয়া ভণ্ডামি দিয়া কখনও মঙ্গল-উৎসবের কল্যাণ-প্রদীপ জ্বলিবে না।’ এ প্রবন্ধে শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিয়ে পূর্বতন ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রবন্ধের মতোই প্রশ্ন রেখেছেন! ‘যাঁহারা জাতীয় বিদ্যালয়ে প্রফেসর বা অধ্যাপক নিযুক্ত হইতেছেন, তাঁহারা সকলেই কি নিজ নিজ পদের উপযুক্ত? ...পবিত্রতার নামে মঙ্গলের নামে এমন জুয়াচুরিকে প্রশ্রয় দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ একদম ফর্সা।’ শিক্ষাক্ষেত্রকে ঢেলে সাজানোর প্রচেষ্টায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কথাও স্মরণ করেছেন। নজরুলের মতে, এমন শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান চালু করতে হবে যেখানে দেশপ্রেম, আত্মসম্মানবোধ, মনুষ্যত্ব, স্বজাতির বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিপাদন করা হবে। শুধু বক্তৃতা বা প্রদর্শনমুখী বিদ্যা নয়; বরং স্থায়ী জ্ঞানমূলক দূরদর্শী দেশপ্রেমিক জ্ঞানতত্ত্বের ‘Epistemology’ পথ ধরে আমরা উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহন করতে সমর্থ হবো।

‘সত্য-শিক্ষা’ প্রবন্ধে দার্শনিক চেতনার মধ্যে মুক্তি নয়; বরং ব্যবহারিক জীবনে শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারা বাস্তব মুক্তি কাজী নজরুল ইসলাম প্রত্যাশা করেছেন। বিজাতির (ইংরেজদের) বিভিন্ন শৃঙ্খল কেটে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেই কেবল হবে না; বরং তাদের অসহযোগিতা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার মতো শক্তি ও সাহসও অর্জন করার কথা বলেছেন। এককথায় শিক্ষা দ্বারা অর্জিত অন্যায়, পরাধীনতা ও অসাম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শক্তি অর্জন করার কথা। আর শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্য তো সেটাই হওয়া উচিত। নজরুলের ভাষায়, ‘শুধু হুজুগে মাতিলে চলিবে না, গলাবাজির চোটে স্টেজ ফাটাইয়া তুলিলে হইবে না,- আমরা দেখিতে চাই কোন্ নেতার চেষ্টায় কোন্ দেশ-সেবকের ত্যাগে কতটি জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হইল। আমরা দেখিতে চাই, আমাদের কতগুলি তরুণের বুকে এই মহাশিক্ষার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হইল! আমরা দেশ-সেবক চিনিব ত্যাগে, বক্তৃতায় নয়।’

‘ভাব ও কাজ’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম শিক্ষার্থীদের আবেগকে বিপথে পরিচালিত না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। স্বরাজ আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের স্পৃহা এবং উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে সে স্পৃহা শক্তি নষ্ট হওয়ার বিবরণ দিয়েছেন। বারবার শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে মাঝপথে তা নষ্ট করে দিলে বৃহত্তর প্রয়োজনে তাদের পাশে পাওয়া যাবে না, সে সম্ভাবনার কথাও ব্যক্ত করেছেন। নজরুলের ভাষায়: ‘একটা সাময়িক উত্তেজনার মুখে এই ত্যাগের অভিনয় করিতে গিয়া ‘স্পিরিট’কে কি বিশ্রী ভাবেই না মুখ ভ্যাঙচানো হইল! যাহারা শুধু ভাবের চোটে না বুঝিয়া শুনিয়া শুধু একটু নামের জন্য বা বদনামের ভয়ে এমন করিয়া তাহাদের ‘স্পিরিট’ বা আত্মার শক্তির পবিত্রতা নষ্ট করিল, তাহারা কি দরকার পড়িলে আবার কাল এমনি করিয়া বাহির হইয়া আসিতে পারিবে?’

মানব মনের মুক্তি ভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান বাংলাদেশেও সম্ভব। প্রশ্নটা কাঠামোগত অর্থাৎ অত্যন্ত জনবহুল ছাত্রসমাজকে কীভাবে মোটামুটি সন্তোষজনক ভৌতসুবিধাদির মধ্যে ঢোকানো যায় সেটাই হলো পরীক্ষা বা চ্যালেঞ্জ। ভৌতসুবিধাদির আয়োজন ও আধুনিকায়ন, শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ ও তৈরি করা, ছাত্র নির্মাণ, জ্ঞান নির্মাণ ও শিক্ষক নির্মাণ-এগুলোর অধিকাংশ নজরুল-কথিত শিক্ষাদর্শ বাস্তবায়নের রাস্তা। স্বদেশি-শিক্ষা প্রবর্তনের মধ্যেই নজরুল ইসলামের শিক্ষা ভাবনা সীমিত থাকেনি। তিনি এই প্রয়াসকে বাস্তবরূপে প্রয়োগের জন্য যোগ্য শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেছিলেন। কিন্তু স্বজনপ্রীতিমূলক শিক্ষক নিয়োগপদ্ধতির মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতিতে নব প্রবর্তিত শিক্ষা ও শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব নব প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার সকল কল্যাণকর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় যে ধস নামাবে এ জাতীয় ভাবনা কাজী নজরুল ইসলামের দৃষ্টিকে এড়িয়ে যায়নি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষাদাতার মধ্যে আন্তরিক সম্পর্কের প্রতিও তিনি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম মনে করেছিলেন, শিক্ষার ক্ষেত্রে এক পারস্পারিক সুসম্পর্ক সর্বদা থাকা উচিত। কারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর যৌথ প্রয়াসেই শিক্ষা হয়ে উঠবে জৈবিক অন্তর্নিহিত সত্তার বহিঃপ্রকাশ। কাজী নজরুল ইসলামের শিক্ষাভাবনা কালোত্তীর্ণ ও ধ্রুপদী। শতবর্ষ পেরিয়ে গেলেও শিক্ষাক্ষেত্রে আজও সমস্যাগুলো বিদ্যমান। হয়নি তেমন ইতিবাচক পরিবর্তন। নজরুল চিন্তাপ্রসূত পদক্ষেপগুলো হতে পারে শিক্ষাক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধানের যৌক্তিক পথ!

লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি।

এসইউ/এমএস

Read Entire Article