গত বছরই তাদের বাড়িভর্তি মানুষ ছিল। কেউ ঈদ সেলামি দিতে আসছেন। কেউ নিতে। কেউবা আবার ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে করতে আসছেন। অথচ বছর না ঘুরতেই আজ তারা কারাগারে আসামি হিসেবে ঈদ পালন করছেন। মন্ত্রী, এমপি এবং নেতা নানা পদ-পদবি আর কতই না দাপট ছিল তাদের। অথচ এখন তাদের হাতে হাতকড়া। পিছমোড়া দিয়ে তাদের তোলা হচ্ছে আদালতে।
ঠিক ধরেছেন। বলছি, পতিত সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা। একসময়ের দোর্দণ্ড দাপুটে এই নেতারা এখন বড্ড অসহায়। তাদের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। কী ছিল না তার? অর্থবিত্ত বা ক্ষমতা! এখন সবই হাতছাড়া। তিনিও ঈদ করছেন কারাগারে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু। আওয়ামী লীগের একসময়ে ‘মিস্টার সিদ্ধান্ত’ নামে খ্যাত এই নেতা দলে অপাঙক্তেয় হলেও এলাকায় আধিপত্য ঠিকই ধরে রেখেছিলেন। তার কাছে হাজিরা দিতে ও দোয়া নিতে হতো বহু শিল্পপতির। বরিশাল অঞ্চলে নেতা হতে হলে হাতেগোনা যে দুই-তিনজনের আশির্বাদ প্রয়োজন হতো, তিনি তাদেরই অন্যতম। প্রতাপশালী এই নেতার গ্রেফতারের পর তার ঢাকার ও ঝালকাঠির বাসা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উদ্ধার হয়েছে। কারাগারে অসহায় ঈদ পালন করছেন তিনিও।
আরও পড়ুন
- ছন্নছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ‘মানবেতর ঈদ’
- দেড় দশক পর বিএনপির ‘ভয়হীন’ ঈদ
- দূরত্ব ঘুচিয়ে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকুন: প্রধান উপদেষ্টা
যদিও সম্প্রতি আদালতে সাবেক এই মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমি ঢাকা বারের সদস্য, হাইকোর্ট বারের সদস্য। এখানকার পরিবেশ দেখে দুঃখিত। এই পরিবেশে কিছু বলা উচিত না। মামলা চলবে, ভবিষ্যতে আমি আমার বক্তব্য উপস্থাপন করবো। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনেক কথা বলেছেন। আমি একজন রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে গেলে দুই ঘণ্টা লেগে যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা একে অপরের ভাই ভাই। মিলে-মিশে থাকা উচিত। আমরা একসঙ্গে থাকবো। কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো? আশা করছি, এ পরিবেশ থাকবে না।’ তার এ কথার মধ্যেই বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা চিৎকার শুরু করেন। তারা বলতে শুরু করেন, তিনি (আমু) ভয় দেখাচ্ছেন। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী তাদের শান্ত করেন। পরে আমু বলেন, ‘আমরা যার যার পক্ষ অবলম্বন করবো। নিজেরা নিজেরা কেন দ্বন্দ্বে জড়াবো।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, ড. আব্দুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান, শাজাহান খান, কাজী জাফরউল্লাহ, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ডা. দীপু মনিরও ঈদ কাটছে কারাগারে। একেকজন একেকটা আসনে ধরাকে সরা জ্ঞান করলেও এখন তাদের অসহায়ত্বে কেউ পাশে নেই।
সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী ও মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা কামাল আহমেদ মজুমদার তো শেষ বয়সে এসে কারাগারের যন্ত্রণা না নিতে পেরে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ারই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি আদালতে বলেন, ‘আমার ৭৬ বছর বয়স। আমার চোখ ৭০ শতাংশ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার পরিবার সম্পর্কে কোনো খোঁজ-খবর নিতে পারছি না। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি করবো না।’
আরও পড়ুন
‘রাজনীতি থেকে ইস্তফা দিলাম। আমি আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। এখন থেকে প্রাথমিক সদস্য পথ থেকেও পদত্যাগ করলাম। একের পর এক মামলা দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক নির্যাতন করা হচ্ছে। এই বয়সে আমার ওপর জুলুম চালানো হচ্ছে। আল্লাহকে ডাক দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই’- বলেন ঢাকার রাজনীতির এই প্রভাবশালী নেতা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথিত ছোটভাই সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকও ঈদ করছেন কারাগারে। সবচেয়ে প্রভাবশালী এই প্রতিমন্ত্রী এখন সবচেয়ে অসহায়। ১০ মার্চ দুদকের মামলায় হাজিরা দিতে আদালতে এসে সাংবাদিকদের দেখে জুনাইদ আহমেদ পলক বলতে শুরু করেন, ‘কথা বললেই রিমান্ড ও মামলার সংখ্যা বাড়ে। হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আটকে রাখে। কথা বলে কী লাভ?’
এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিমসহ দলটির জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অসংখ্য নেতা এবছর কারাগারে ঈদ করছেন।
এসইউজে/এমকেআর/এমএস