কালি উৎপাদন কারখানার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন, ফসলের ক্ষতি

4 days ago 11

পাবনা বেড়া উপজেলায় পাটকাঠি পুড়িয়ে উৎপাদন হচ্ছে কালি। এ থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া ও ছাইয়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। বিষাক্ত ধোঁয়া ও ছাইয়ে অতিষ্ঠ কয়েক গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার বাসিন্দা। দীর্ঘ চার বছর ধরে প্রকাশ্যে এ কারখানা পরিচালনা হলেও অজ্ঞাত কারণে এটি বন্ধে কেউ ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

গ্রামবাসী ও কারখানা সূত্রে জানা যায়, চার বছর আগে রুপপুর ইউনিয়নের ধর্মগঞ্জ গ্রামে সাত বিঘা ফসলি জমিতে ইয়াং বাংলা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ নামের একটি কোম্পানি কালি উৎপাদনের কারখানা স্থাপন করে। যার মালিকানা কাশিনাথপুরের আমিনুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। ওই কারখানায় বিশাল আকারের ২৪টি চুল্লিতে পাটকাঠি পুড়িয়ে কালি তৈরি করা হয়। প্রতি চুল্লিতে ৭৫-৮০ মন করে পাটকাঠি পোড়ানো হয়। যা থেকে তৈরি হয় কার্বন কালি। এর ফলে প্রচুর ধোঁয়া হয়। ওই ধোঁয়া এবং ছাইয়ের কারণে এলাকাবাসী হাঁচি-কাশিসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এরই মধ্যে এলাকার বৃদ্ধ ও শিশুদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। এছাড়া নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি।

সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার চারপাশে ফসলি জমি ও আবাসিক এলাকা। আশপাশের পুকুরের পানি কালো হয়ে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া ওই এলাকার ফসলি জমির মাটি এবং গাছগুলো কালো হয়ে গেছে। পরিবেশ দূষণকারী এ কারখানার জন্য ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রুপপুর, ভাটিকয়া, বৃন্দপাড়া, উজানকয়া ও হঠাৎপাড়াসহ পার্শ্ববর্তী আশ্রয়ণ প্রকল্প মুজিববর্ষ গ্রামের বাসিন্দারাও। এতে উদ্বেগ বেড়েছে স্থানীয়দের।

ভাটিকয়া গ্রামের কৃষক জুলমত শেখ জানান, রাত ৯টা থেকে ভোর পর্যন্ত পাটকাঠি পোড়ানো হয়। তখন এই এলাকা ছাই আর কালো ধোঁয়ায় ভরে যায়। এলাকার মানুষ ঠিকমতো নিশ্বাস নিতে পারে না। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আম গাছে মুকুল পর্যন্ত ধরে না, সব গাছের পাতা কালো হয়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা অনেক জায়গায় অভিযোগ দিয়েছেন। প্রশাসন সব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নেয় না।

কালি উৎপাদন কারখানার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন, ফসলের ক্ষতি

স্থানীয় আকলিমা খাতুন জানান, রাত হলেই ধোঁয়া আর ছাইয়ে অন্ধকার হয়ে যায়। ঘরের টিন কালো হয়ে গেছে। পাটের বস্তা দিয়ে জানালা আটকে রেখেছি। তবুও ঘরে ছাই আসে। ভাত খেতেও পারি না ঠিকভাবে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, চোখ জ্বালাপোড়া করে। বাচ্চারা অসুস্থ হচ্ছে।

আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখতে হয় ছাই পড়ে বিছানা কালো হয়ে আছে। অন্যান্য সব ক্ষেত্রেই কারখানার কালো ধোঁয়া ভোগান্তি বাড়িয়েছে। মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় এ নিয়ে কিছু বলার সাহস নেই কারোর। অনেকেই অতিষ্ঠ হয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেছে।

রুপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মোজাহারুল ইসলাম (মোহন) বলেন, কালি তৈরির কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি এর আগেও প্রশাসনকে অবগত করেছি। এতে কোনো কাজ হচ্ছে না। এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কারখানায় চুল্লি জ্বালানোর কাজ করা এক শ্রমিক জানান, এ কাজ একটানা কয়েকদিন করা যায় না। নাক-মুখ বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়ার চাহিদা থাকে না। ঘুমেও সমস্যা হয়। জিনিসপত্রের যে দাম, সংসারে চালানো কঠিন। তাই বাধ্য হয়ে এখানে কাজ করছি। অসহায় শ্রমিক ছাড়া এ কাজ কেউ করতে আসে না। তবে চিন্তা করছি দ্রুত কাজ ছেড়ে দেবো।

কালি উৎপাদন কারখানার ধোঁয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন, ফসলের ক্ষতি

কালো ধোঁয়া ও ছাই পরিবেশ এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি জানিয়ে বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফাতেমাতুজ জান্নাত বলেন, এ ধরনের ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগ হতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী হলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে এ ধরনের ধোঁয়া নির্গত হয়- এমন কারখানা পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

এদিকে কারখানা থেকে ক্ষতিকর কোনো ধোয়া বা ছাই নির্গত হয় না দাবি করছেন মালিক ও পরিচালক আমিনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এ কারখানাটি বিশেষ প্রক্রিয়া মেনে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে ক্ষতিকারক ধোয়া হওয়ার সুযোগ নেই। তেমন ছাইও হয় না। এখান থেকে উৎপাদিত কালি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে ভূমিকা রাখছে। ৪০ কেজি পাটকাঠি পুড়িয়ে ১০ কেজি কালি উৎপাদন হয়। যা ১২ কেজি ওজনের প্যাকেট করে চীনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়।

এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম জানান, আমি এটি অবগত নই। তবে বেড়ার ইউএনওকে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলবো।

আলমগীর হোসাইন নাবিল/জেডএইচ/এএসএম

Read Entire Article