কুরুক্ষেত্রের ঘুড়ি: কবিতার আকাশে অবিরাম দোল খাওয়া

1 month ago 8

শাদমান শরীফ

চৈতন্য থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মাইনুল ইসলাম মানিকের কাব্যগ্রন্থ ‘কুরুক্ষেত্রের ঘুড়ি’। ছত্রিশটি ভিন্নধর্মী কবিতার এক চমৎকার সন্নিবেশ হয়েছে গ্রন্থটিতে। অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত গ্রন্থটিতে উঠে এসেছে প্রেম-অপ্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতা আর তীব্র শ্লেষের সাথে বর্ণিত হয়েছে সমকালীন রাজনীতি ও সমাজবাস্তবতার অভিঘাত।

প্রতিটি কবিতাই অত্যন্ত সুপাঠ্য। কবিতার ভাষা অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাণবন্ত। প্রায় প্রতিটি কবিতাই আমাদের বোধের জগতকে নাড়া দিয়ে যায়। গ্রন্থটির প্রথম কবিতা ‘ফেরাও তোমার ঘোড়া’। কবিতায় কবি তার বন্ধুবেশী শত্রুকে বলছেন, ‘কে তুমি যুধিষ্ঠির চতুর্দিকে ঘিরেছো আমায়? তোমার তামাটে চুরুটের গন্ধ আমার চেনা।’ কতিাটিতে উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যবহার যে কোনো পাঠককে চমকে দেবে।

‘রুটি’ কবিতায় খুবই সহজ অথচ সাবলীল ভাষায় বলেছেন, ‘রুটির পেছনে ছুটতে ছুটতে প্রায়ই আমাদের ছুটি হয়ে যায়, কখনো কখনো অর্ধেক পথ পেরিয়ে টের পাই চলে এসেছি ভুলপথে... পৃথিবীটা রুটির মতো গোলগাল, রুটি ভেবে আমাদের কেউ কেউ প্রতিদিন আস্ত পৃথিবীটাই খেয়ে ফেলি।’ জীবন ও জগতের উপাখ্যান এত সহজে তুলে আনতে পারা কবির সামর্থের জানান দেয়।

‘ভলতেয়ার জানেন’ কবিতায় কবি প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও শাসকদের প্রতি ছুড়ে দিয়েছেন তীব্র শ্লেষ। তিনি দেখিয়েছেন, বিপ্লবী চিরকালই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে কিন্তু বীর্যপাত হয়ে গেলে ক্ষমতার উত্থিত শিশ্ন উবু হয়ে যায়। তার ‘কবন্ধজীবন’ কবিতাটির একটি পঙক্তি উল্লেখ না করলেই নয়, ‘মুখ খুললেই সামনে এসে দাঁড়ায় মুনকার-নাকির/ জীবিত হয়েছি আবার—এই অভিযোগে/ অবিরাম চলতে থাকে সওয়াল জওয়াব/ আমার দিকে তেড়ে আসে নিরানব্বইটি বিষধর সাপ/ আমাকে ফেলা হয় জ্বলন্ত অগ্নিতে।’

শুধু এ কবিতাটিতেই নয়, এ গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতায়ই তার শ্লেষাত্মক ও ব্যঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্যণীয়। গ্রন্থটির উল্লেখযোগ্য কিছু দ্রোহের কবিতার মধ্যে রয়েছে—‘ক্রুশকাঠে ঝুলে যেতে যেতে’, ‘ঘাতকের মুখ’, ‘উত্তরাধুনিক গণতন্ত্র’, ‘কবন্ধজীবন’, ‘পুড়ে যাবে নিষিদ্ধ নরক’, ‘নিরোর প্রেম’, ‘মনসার কাল’, ‘কাঁটাতারে পাখি’ ও ‘বেদখল আকাশ’ প্রভৃতি।

কথা বলতে গিয়ে আমরা প্রায়ই খেই হারিয়ে ফেলি। আমাদের কথা বুলেট হয়ে আমাদেরকেই তাড়িয়ে ফেরে। তাই কবি কথাদের জন্য প্রশিক্ষণশালা খুলেছেন। ‘প্রশিক্ষণ চলছে’ নামে এমন দুর্দান্ত একটি কবিতা এ বইয়ে স্থান পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘অল্পতেই উপচে পড়ত যে সকল কথা/ এখন নিজের তৈরি ব্যারাকে আটকে রাখি তাদের/ দুবেলা প্যারেড করাই...’। বইটিতে অল্প কয়েকটি প্রেমের কবিতাও স্থান পেয়েছে। স্থান পেয়েছে কয়েকটি বিরহ-বিষাদের কবিতাও।

‘আধখাওয়া ফলের লোভে’ একটি ছোট্ট পরিসরের কবিতা; যেখানে কবি অত্যন্ত সকরুণভাবে বিগত প্রেমিকাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, ‘আমি এক অদৃশ্য দর্শক/ আধখাওয়া ফলের লোভে ঝুলে থাকা অভুক্ত বাদুড়।’ গ্রন্থটিতে শুধু রূপক, উপমা বা উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারই নয়, মিথের চমৎকার ব্যবহারও লক্ষ্যণীয়। মিথগুলোকে কোথাও আরোপিত মনে হয়নি, মনে হয় বর্ণনার প্রয়োজনেই অত্যন্ত সাবলীলভাবে চলে এসেছে। ‘তুমি আমায় দুঃখ দেওয়ার কে?’ কবিতা থেকে একটি পঙক্তি নেওয়া যাক, ‘তুমি আমায় অন্ধ করে দেবে?/ আমার চোখ খুলে নিই আমি ঈডিপাস।’

কবি মাইনুল ইসলাম মানিক অত্যন্ত স্পষ্টবাদী লেখক। তিনি একাধারে গদ্যকার, অনুবাদক ও সংগঠক। তিনি তার কবিতায়ও সমান দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। পাঠক বইটি পাঠে ভাবনার বৈচিত্র্যময়তার পাশাপাশি সহজ অথচ আধুনিক শব্দচয়নে প্রবলভাবে মুগ্ধ হবেন। প্রায় প্রতিটি কবিতায়ই বিষয়বৈচিত্র্য রয়েছে। পাঠক বইটি পাঠে সমৃদ্ধ হবেন এ বিশ্বাস রাখি। তিন ফর্মার বইটি প্রকাশ করেছে চৈতন্য। প্রচ্ছদ করেছেন নির্ঝর নৈঃশব্দ্য। মুদ্রিত মূল্য ২০০ টাকা।

এসইউ/এএসএম

Read Entire Article