কৃষি কর্মকর্তার বদলি ঠেকাতে খাবারের বিনিময়ে উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ

2 weeks ago 18

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল ইসলামের বদলির আদেশ বাতিলের দাবিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকসহ কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে রাখাসহ দিনভর ঘটেছে নানা ঘটনা। মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) নানা নাটকীয়তা শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতাদের হস্তক্ষেপে ওই কর্মকর্তারা বিকেলে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হন এবং উত্তেজনার অবসান হয়।

মূলত আমিরুল হক রাসেল নামে এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি স্থগিত করতে লোকজন দিয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অর্ধেক কর্মদিবস অবরুদ্ধ করে রাখার অভিযোগ উঠেছে।

মঙ্গলবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারদিন বাবুল সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং কৃষকদের শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করার পর আন্দোলনকারীরা আবার চড়াও হন। পরে ছাত্রদল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চুয়াডাঙ্গার নেতাকর্মীরা গিয়ে ওই উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে মুক্ত করেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেন।

জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আমিরুল হক রাসেলসহ যশোর অঞ্চলাধীন চারজন কর্মকর্তাকে গত ৯ ডিসেম্বর তাৎক্ষণিক বদলির আদেশ দেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোর অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আজগর আলী। ওই বদলির পত্রে ১০ ডিসেম্বর তারিখের মধ্যে ছাড়পত্র নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলকে মাগুরা জেলার মহাম্মদপুর উপজেলা কৃষি অফিসে বদলি করা হয়।

তবে ১০ তারিখ অর্থাৎ মঙ্গলবার ছাড়পত্র নেয়ার নির্ধারিত দিনে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ করার চেষ্টার অভিযোগ ওঠে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলের বিরুদ্ধে। মিটিংয়ের নাম করে দুপুরের খাবার ও অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কৃষকসহ অন্যান্য লোকজনকে আনা হয় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসে।

এদিন দুপুরে সরেজমিনে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা যায়, একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি ঠেকাতে সেখানে লোকজন জড়ো হয়েছেন। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বলতে পারছেন না কেন তারা সেখানে এসছেন। দুপুরের খাবার দেওয়ার সময় সদর উপজেলার আরেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান ছাত্রদের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ওই দপ্তরে চাকরি করে ওই দপ্তরের কর্মকর্তাকে যারা অবরুদ্ধ করছেন, তাদেরকে কিভাবে খাবার সরবরাহ করছেন এমন প্রশ্ন করছিলেন শিক্ষার্থীরা।

এ সময় ওই কর্মকর্তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেল মুঠোফোনে কল দিতে বলতে শোনা যায়। মুঠোফোনে লাউডে কথা হলে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন ওই উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বদলি হওয়া রাসেলের সঙ্গে যোগসাজসে আছেন।

ওই সময় ওখানে বেশ কয়েকজন ছাত্র প্রতিনিধি ও ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ তোলেন, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। তিনি আওয়ামী লীগের লোকজনকে নানাভাবে সুবিধা দিতেন। আওয়ামী লীগের ইন্ধনেই একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে।

কৃষি কর্মকর্তার বদলি ঠেকাতে খাবারের বিনিময়ে উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা খবর পাই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালককে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। আমরা এখানে এসে দেখি বেশকিছু লোকজন কৃষি অফিসের নিচে এবং দোতলায় অবস্থান করছেন। পরে উপপরিচালকের কক্ষে গেলে দেখি লোকজন একজন উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলির দাবি জানাচ্ছেন। কোনো লিখিত অভিযোগ নয়, লিখিত দাবিও নয়। তারা মৌখিকভাবে বদলি স্থগিত করার জন্য উপ-পরিচালককে চাপ দিচ্ছিলেন। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলি। কথা বলে মনে হয়, তারা কিছু একটা ভুল করছেন বা প্রলোভিত হয়ে এসছেন। পরে আরও ভালোভাবে বিস্তারিত খোঁজ নেয়ার পর দেখা যায়, ওখানে আসা অল্প চার-পাঁচজন বাদে কেউ জানেনই না কেন সেখানে গেছেন। তাদেরকে বোঝানো হয়েছে, একটি মিটিং আছে। দুপুরের খাবার এবং ৩শ থেকে ৫শ টাকা দেওয়া হবে। আমরা বিষয়টি অনুধাবন করে তাদেরকে প্রথমে অনুরোধ করি, একটি লিখিত আবেদন দিয়ে যেতে। কারণ উপ-পরিচালকের বদলির আদেশ স্থগিত করার এখতিয়ার নেই। কিন্তু যারা এসছিলেন, সকলেই উগ্রতা দেখিয়ে তাদের দাবি মেনে নিতে চাপ প্রয়োগ করেন। পরে ঘটনাস্থলে ছাত্রদলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হলে তাদের সহযোগিতায় বিষয়টি আরও যখন জানার চেষ্টা করা হয়, তখন প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসে। মূলত টাকা দিয়ে নাটক সাজিয়ে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

পরে সকলের পরিচয় জানতে চাইলে ধীরে ধীরে প্রায় সকলেই ওখান থেকে চলে যান। তারপরও কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন হলেন হানুরবাড়াদী গ্রামের আবুল কালাম, নেহালপুর গ্রামের সোহেল, কোটালী গ্রামের মোস্তফা আল সাদিক, বেগমপুর গ্রামের ফয়সাল প্রমুখ।

সরেজমিনে কয়েকজনকে সেখানে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে হেলাল নামে একজন বলেন, ‘আমার কুটুম ডেকে নিয়ে এসছে। আমি ইজিবাইক চালাই। কী কাজ জানিনে। বলেছে মিটিং আছে, গেলে দিন-হাজরে দেবে।’

সজিব নামের আরেকজন বলেন, ‘আমাকে গাড়ির ড্রাইভার ডেকে নিয়ে এসেছে। কী কাজ জানি না।’

সদর উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি ডিডির অবরুদ্ধ করার খবরে দেখতে গেছি। আমি কারো সঙ্গে নেই। আমি কোনো কিছু করিনি। খাবারও আমি দিইনি, হোটেলে খোঁজ নেন, কে দিয়েছে বেরিয়ে আসবে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চুয়াডাঙ্গার আহ্বায়ক আসলাম অর্ক বলেন, আমরা সেখানে গিয়ে এক প্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় পাই জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালককে। একপর্যায়ে আমরা সব ঘটনা শুনি। যারা উপপরিচালককে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন, তাদেরকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে গোলযোগ করার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। ছাত্রদলের সহযোগিতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। এর পেছনে বদলিকৃত কর্মকর্তা আছেন বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মাসুদুর রহমান সরকার বলেন, সদর উপজেলার একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার বদলি স্থগিত করার অযৌক্তিক দাবিতে আমাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। আদেশ স্থগিত না হওয়া পর্যন্ত আমার ওপর চাপট দেওয়া হচ্ছিল। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্রদলের ছেলেরা এসে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন। যারা এসছিলেন, তাদেরকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল। তবে বেশিরভাগই জানতেন না, কেন এসছেন। দুপুরের খাবার ও টাকার লোভ দেখিয়ে তাদেরকে এখানে আনা হয়। আমরা এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করবো। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

অভিযুক্ত চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসে কর্মরত উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. আমিরুল হক রাসেলের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এজন্য তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

হুসাইন মালিক/এফএ/এএসএম

Read Entire Article