কৃষিজমি সুরক্ষায় আসছে কঠোর অধ্যাদেশ

2 hours ago 1

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসন ও উন্নয়নমূলক নানান কর্মকাণ্ডের কারণে কৃষিজমি প্রতিনিয়তই কমছে। কৃষিজমি সুরক্ষায় একটি আইন করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন আগে শুরু হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে অবশেষে কৃষিজমি সুরক্ষায় আসছে কঠোর একটি অধ্যাদেশ।

এরই মধ্যে নানান প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ‘ভূমি ব্যবহার ও কৃষিভূমি সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’র খসড়া করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। খসড়ায় কৃষিজমির সুরক্ষায় জোর দেওয়া হয়েছে। কৃষিজমি রক্ষায় যুক্ত হচ্ছে কঠিন বিধি-বিধান। কৃষিজমিতে অকৃষি কার্যক্রম করলে পড়তে হবে কঠোর শাস্তিতে। আইন লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা।

খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, গঠন হবে ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’। কর্তৃপক্ষ কৃষিজমির ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করবে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকাকে ভূমির বিদ্যমান ব্যবহার, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভূমিরূপ যথাযথভাবে পরীক্ষা করে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ধারণ করা প্রতিচ্ছবি, সরেজমিনে পরিদর্শন ও বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন অঞ্চলকে ব্যবহারভিত্তিক বিভাজন বা ভূমি জোনিং করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে।

শিগগির সব পক্ষের মতামত ও অন্য প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে খসড়াটি অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন-২) মো. মঈনুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের মানুষ বেশি কিন্তু ভূমি কম। তাই আমাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। ভূমি উপদেষ্টা, পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা এবং কৃষি উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা একটি অধ্যাদেশের খসড়া করেছি। সেখানে মূল ফোকাস কৃষিজমি সুরক্ষা।’

তিনি বলেন, ‘খসড়াটি এক দফা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদ পর্যবেক্ষণ দিয়ে এটি ফেরত পাঠায়। পরিষদ কৃষিজমি সুরক্ষায় বিষয়টিকে জোর দিতে বলে। সেই অনুযায়ী আমরা খসড়াটি করছি।’

উপসচিব আরও বলেন, ‘খসড়ার বিষয়ে আমরা মতামত নিচ্ছি। এরপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে খসড়াটি চূড়ান্ত করে শিগগির উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদনের জন্য পাঠাবো।’

আরও পড়ুন

কৃষিজমি রক্ষায় আসছে সমন্বিত উদ্যোগ
কৃষিজমি রক্ষায় চ্যালেঞ্জ খাদ্যনিরাপত্তা
উপকূলে বাড়ছে লবণাক্ততা কমছে কৃষিজমি

খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ভূমির উপরিভাগের ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা না মানলে ও কৃষিজমি বাদে অন্য শ্রেণির ভূমির ক্ষতিকর পরিবর্তন রোধে নির্দেশনা না মানলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে। এছাড়া কৃষিজমিতে নিয়ম মেনে বসতবাড়ি নির্মাণ ছাড়া অকৃষি কাজে ব্যবহার করলে শাস্তি পেতে হবে। কর্তৃপক্ষ জমিতে অননুমোদিতভাবে নির্মাণ করা স্থাপনা অপসারণ করে বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রি করতে পারবে।

কৃষিজমি সুরক্ষায় আসছে কঠোর অধ্যাদেশ

এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। এক্ষেত্রে শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড।

খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, কোনো রিয়েল এস্টেট কোম্পানি বা কোনো হাউজিং সোসাইটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে কৃষিজমিতে অননুমোদিতভাবে হাউজিং এস্টেট তৈরি করলে বা হাউজিং এস্টেট তৈরির উদ্দেশ্যে অধিক পরিমাণ কৃষিজমি দখল করে রাখলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে।

আমাদের মানুষ বেশি কিন্তু ভূমি কম। তাই কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। ভূমি উপদেষ্টা, পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা এবং কৃষি উপদেষ্টার নেতৃত্বে আমরা একটি অধ্যাদেশের খসড়া করেছি। সেখানে মূল ফোকাস কৃষিজমি সুরক্ষা।- ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (আইন-২) মো. মঈনুল হাসান

একই সঙ্গে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা কোম্পানি বা শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক, বিমা কোম্পানি, পুঁজিপতি বা কোনো এনজিও বা কোনো ক্লাব কৃষিকাজ ছাড়া বাণিজ্যিক বা বিনোদন কেন্দ্র, রিসোর্ট বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে অননুমোদিতভাবে বিধি দিয়ে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি কৃষিজমি দখল করে রাখলে এমন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সোসাইটি বা এনজিও বা ক্লাব বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেকেই সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি বেড়ে দ্বিগুণ হবে। এক্ষেত্রে দুই বছরের কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা দিতে হবে।

আদালত উপযুক্ত মনে করলে অপরাধে উপকরণ ও আলামত জব্দ এবং বাজেয়াপ্ত করে নিলামে বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারবে বলেও খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে।

খসড়ায় বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করবে। একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য নিয়ে কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। চেয়ারম্যান হবেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদে কর্মরত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দুজন সদস্য নিয়োগ করা হবে।

কর্তৃপক্ষ গঠন না হওয়া পর্যন্ত ভূমি সংস্কার বোর্ড ‘বাংলাদেশ ভূমি জোনিং ও ভূমি সুরক্ষা কর্তৃপক্ষের সব ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করবে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন বলে খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, কর্তৃপক্ষ কৃষিজমি সুরক্ষা ও জোনভিত্তিক ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতে সারাদেশে একই সঙ্গে বা পর্যায়ক্রমে একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকার বা মৌজার ভূমির বিদ্যমান ব্যবহার, প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও ভূমিরূপ যথাযথভাবে পরীক্ষা করে মৌজা, দাগ বা অন্য কোনো চিহ্ন বা সীমারেখা দিয়ে সারাদেশে ‘ভূমি ব্যবহার জোনিং ম্যাপ’ ও স্থানিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করবে, ডাটাবেজ সংরক্ষণ ও নিয়মিত হালনাগাদ করবে।

ভূমির ব্যবহারভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের ভিত্তিতে ভূমি সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে। দেশের কৃষিজমি পরিমাপ করে মোট কৃষিভূমির কমপক্ষে ৮০ শতাংশ কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেবে কর্তৃপক্ষ।

ভূমি জোনিংয়ের উদ্দেশ্যে ভূমিকে ১৪টি শ্রেণিতে ভাগ করা যাবে বলে খসড়ায় জানানো হয়েছে। শ্রেণিগুলোর মধ্যে রয়েছে- কৃষি অঞ্চল, কৃষি-মৎস্য চাষ অঞ্চল, নদী ও খাল, জলাশয়, পরিবহন ও যোগাযোগ অঞ্চল, শহুরে আবাসিক অঞ্চল, গ্রামীণ বসতি অঞ্চল, মিশ্র ব্যবহার অঞ্চল, বাণিজ্যিক অঞ্চল, শিল্প অঞ্চল, প্রাতিষ্ঠানিক ও নাগরিক সুবিধা অঞ্চল, বন ও বৃক্ষরোপণ অঞ্চল, সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য অঞ্চল এবং পাহাড় টিলা।

কৃষিজমি সুরক্ষায় আসছে কঠোর অধ্যাদেশ

খসড়ায় ভূমি জোনিং ম্যাপ প্রণয়নের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। জোনিং ম্যাপের বিরুদ্ধে আপত্তি গ্রহণ, শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য জেলা প্রশাসকের (ডিসি) নেতৃত্বে জেলা কমিটি থাকবে। জেলা কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল গ্রহণ, শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে থাকবে বিভাগীয় কমিটি।

কৃষিজমি সুরক্ষায় যা করতে হবে

খসড়ায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে সব কৃষিভূমি সুরক্ষা করতে হবে জানিয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কৃষিভূমি ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না বা শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না যে কৃষিভূমির শ্রেণি পরিবর্তন হয়ে যায়। তবে অকৃষি বা অন্য কোনো শ্রেণির ভূমি কৃষিকাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না।

দুই বা এর বেশি ফসলি কৃষিভূমি কোনো অবস্থায়ই কৃষি ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। এক ফসলি ভূমিকেও কৃষিভূমি হিসেবেই ব্যবহার করতে হবে। তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব, জনস্বার্থ বিবেচনায় ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ এক ফসলি কৃষিভূমি সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা স্থাপন বা কৃষিসংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক কার্যক্রম বা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যাবে।

কোনো ব্যক্তি ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ ভূমি ব্যবহার করে নিজ কৃষিভূমিতে বসতবাড়ি, উপাসনালয়, কবরস্থান, সমাধি, গুদামঘর, পারিবারিক ব্যবহারের জন্য পুকুর, দোকানপাট, কুটির শিল্পসহ বসতবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কিত স্থাপনাদি নির্মাণ করতে পারবেন। ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমির অতিরিক্ত জমি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ব্যবহার করতে পারবেন না।

জমির ব্যবহারভিত্তিক সর্বোচ্চ সীমা বিধি দিয়ে নির্ধারণ করা যাবে। বন, জলাভূমি, নদী, পাহাড় ও টিলা শ্রেণি এবং সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের ভূমি কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না।

দেশের খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে ভূমি জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে সরকার দেশের কোনো অঞ্চল বা এলাকাকে ‘বিশেষ কৃষি অঞ্চল’ হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারবে। কোনো ভূমিতে জ্বালানি বা খনিজসম্পদ বা প্রত্নসম্পদ পাওয়া গেলে বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সরকার ওই ভূমি থেকে সম্পদ আহরণ বা অনুসন্ধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে এ আইনের বিধানাবলি কোনো বাধা হবে না। তবে এমন কার্যক্রম সম্পর্কে ভূমি মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে রাখতে হবে।

আরএমএম/এএসএ/এমএফএ/এমএস

Read Entire Article