দেশের খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে কৃষিপ্রধান উত্তরাঞ্চলীয় জেলা বগুড়া। ধান, আলু, দুধ, সবজি এবং গরু উৎপাদনে এ জেলার অবদান অনস্বীকার্য। তবে এই কৃষিনির্ভর জেলার কৃষকরা নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই জেলার কৃষি খাতের অগ্রগতি দেশের অর্থনীতিকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারে।
কৃষি উৎপাদন এবং বৈচিত্র্য
বগুড়া জেলার কৃষি উৎপাদন এবং বৈচিত্র্য অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখানকার কৃষি খাত দেশের কৃষি অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। ধান উৎপাদনে এগিয়ে রয়েছে বগুড়া। কৃষি খাতে বোরো ধান উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে। এই ধান সারা দেশে খাদ্য নিরাপত্তা বজায় রাখতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জেলায় প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। যার মাধ্যমে বছরে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হয়। এছাড়া এ জেলায় বছরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন আমন ধান উৎপাদিত হয়। এটি মৌসুমী চাষ হিসেবে স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা পায়।
অন্যদিকে বগুড়া দেশের সবচেয়ে বড় আলু উৎপাদক জেলা। বিশেষত শীতকালীন আলুর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। এই জেলার আলু উৎপাদন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক চাহিদা তৈরি করেছে। বছরে প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয় এখানে। যা দেশের মোট আলু উৎপাদনের প্রায় ২৫%-৩০%। এছাড়া বগুড়ায় সবজি উৎপাদন (শীতকালীন) হয় ব্যাপকহারে। এখানে প্রধান সবজি হিসেবে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, গাজর, মিষ্টি আলু এবং শিম চাষ করা হয়।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, এই জেলায় টমেটো উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন। বেগুন প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন, ফুলকপি প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন, গাজর প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন ও শিম প্রায় ৮ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়। শীতকালীন এসব সবজি দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ হয় এবং স্থানীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এছাড়া ফল উৎপাদনেও রেকর্ড রয়েছে এই জেলার। কিছু নতুন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। অনেক অঞ্চলে পেঁপে, কলা ও আমের চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানে পেঁপের উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন। কলা প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন। যদিও আমের উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। তবে গাবতলী, শিবগঞ্জ এবং কাহালু উপজেলায় আমের চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং বিদেশি বাজারে রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।
গবাদি পশু এবং মৎস্য চাষেও সফলতা অনেক বেশি। বগুড়ায় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে প্রায় ২০ হাজার গরু ও ১৫ হাজার মহিষ পালন করা হয়। গাবতলী ও শিবগঞ্জে বড় বড় গরু খামার রয়েছে। বগুড়ার দুধ উৎপাদন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই জেলার বেশিরভাগ খামার খোলাবাজারে দুধ সরবরাহ করে এবং কিছু অংশ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রপ্তানি করা হয়। নদী এবং পুকুরে মাছচাষের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে। জেলার প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমি মাছ চাষের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রধান মাছ হিসেবে রুই, কাতলা, পাঙ্গাশ ইত্যাদি চাষ হয়।
আশার কথা হলো, বগুড়ায় অনেক কৃষক জৈব পদ্ধতিতে চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছেন। নানা প্রাকৃতিক উপাদান যেমন গোবর, পচা পাতা, কম্পোস্ট এবং অন্যান্য জৈব সার ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জৈব আলু এবং জৈব সবজি চাষে কৃষকরা সাফল্য অর্জন করেছেন। যা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
কৃষি খাতের সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বগুড়া কৃষি পর্যটন বা এগ্রো ট্যুরিজম ক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনাময় জেলা হতে পারে। বিশেষত ঐতিহাসিক স্থান যেমন মহাস্থানগড়ের কাছে কৃষি খামার পরিদর্শন ও ফসল চাষের শিক্ষাদানের জন্য পর্যটকদের আকর্ষণ করা যেতে পারে। আলু, দুধ এবং শীতকালীন সবজি সংরক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আধুনিক কোল্ড স্টোরেজ এবং ফ্যাক্টরি তৈরি করা হলে কৃষকদের জন্য আরও বেশি অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি হতে পারে। বগুড়ার কৃষকরা যদি তাদের পণ্যের সরাসরি বিক্রির জন্য নতুন বাজার তৈরি করতে পারে তাহলে তাদের আয়ের পরিমাণ আরও বাড়ানো সম্ভব হবে। বিশেষ করে স্থানীয় পণ্যগুলোর জন্য রপ্তানি বাজার খোলা যেতে পারে।
স্থানীয় কৃষকরা যা বলছেন
সোনাতলা উপজেলার কৃষক আবদুল করিম বলেন, আমরা আলু চাষ করি, কিন্তু সঠিক দামে বিক্রি করতে পারি না। কোল্ড স্টোরেজ কম থাকায় অনেক সময় কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হই।
নন্দীগ্রামের তরুণ কৃষক মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের সবজির চাহিদা বেশি কিন্তু পরিবহন খরচ ও বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে লাভের অংশ কমে যায়।
প্রধান চ্যালেঞ্জ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
ফসল সংরক্ষণের জন্য আধুনিক কোল্ড স্টোরেজের অভাব সবচেয়ে বড় সমস্যা। বিশেষত আলু ও দুধের ক্ষেত্রে এই অভাব সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়। কৃষি পণ্যের বাজারমূল্য নির্ধারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রভাব বিস্তার করে। ফলে কৃষকরা তাদের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার এবং সঠিক প্রশিক্ষণের অভাবে অনেক চাষি এখনও প্রচলিত পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা, খরা, এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাত বগুড়ার কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য হুমকি সৃষ্টি করে।
বিশেজ্ঞরা বলছেন, বগুড়ার কৃষি খাতকে আরও এগিয়ে নিতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। এরমধ্যে রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নত বীজ, সেচ পদ্ধতি এবং মেকানাইজড চাষের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।
রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণ
আলু, দুধ ও সবজির মানোন্নয়ন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষি প্রণোদনা ও সহজলভ্য ঋণ। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে কৃষি ঋণ এবং ভর্তুকি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় কৃষি মার্কেটে মধ্যস্বত্বভোগীদের এড়াতে কৃষকদের জন্য সরাসরি বিক্রির ব্যবস্থা করা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। এছাড়া কৃষি উন্নয়নে সরকারি সহযোগিতার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হাবিবুল আলম বলেন, আমাদের চেষ্টা রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাড়ানোর। তবে বাজেট এবং লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো দরকার।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. রাশেদুল ইসলাম বলেন, বগুড়ার কৃষি অর্থনীতি দেশের জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সঠিক দিকনির্দেশনা, আধুনিক প্রযুক্তি, এবং বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে এটি সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
তিনি বলেন, বগুড়ার কৃষিখাত দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। যথাযথ উদ্যোগ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এই খাতকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। এটি শুধু স্থানীয় কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে না বরং জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
এফএ/এএসএম