‘ও হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নিল কেন!’ কিংবা ‘একবার যদি বলতো সে এতো কষ্টে আছে’— পরিচিত কারও আত্মহত্যার খবরে প্রায়ই এমন কথা শোনা যায়। অনেক সময় মনে হয়, বিষয়টি যেন হঠাৎ ঘটে গেছে। কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যার আগে মানুষ কিছু না কিছু সংকেত দিয়ে যায়। কষ্টে থাকা মানুষটি হয়তো সরাসরি কিছু বলতে পারে না, তবে আশপাশের মানুষ খেয়াল করলে অনেক ট্র্যাজেডি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়ার্ল্ড মেন্টাল হেলথ ডে ২০১৭-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন। দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এ সংখ্যা ১০ থেকে ১৪ হাজার পর্যন্ত।
অন্যদিকে আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, কেবল ২০২৪ সালেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।
আজ ১০ সেপ্টেম্বর— বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। তাই দিনটিকে ঘিরে জেনে নিন, কোন কোন লক্ষণে বোঝা যেতে পারে আপনার পরিচিত কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবছেন কি না—
১. কঠিন পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেবার কথা বলা
কেউ যদি বারবার বলেন, ‘আমার আর বেঁচে থাকার মানে নেই’, ‘সব শেষ করে ফেললেই ভালো’, বা ‘আমি সবার বোঝা হয়ে গেছি’— এগুলোকে হালকাভাবে নেবেন না।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ (NIMH) এবং আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন (AFSP)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, এ ধরনের বাক্য সরাসরি আত্মহত্যাপ্রবণ চিন্তার ইঙ্গিত বহন করে।
২. আচরণে পরিবর্তন
শুধু কথায় নয়, আচরণেও বড় পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন : হঠাৎ বন্ধু বা পরিবারের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া, নিজের প্রিয় জিনিসপত্র অন্যকে দিয়ে দেওয়া, বেপরোয়া কাজ শুরু করা (অতিরিক্ত মাদক গ্রহণ ইত্যাদি) এবং দীর্ঘদিন হতাশার পর হঠাৎ অস্বাভাবিক চুপ হয়ে যাওয়া।
NIMH ও AFSP-এর গবেষণা অনুযায়ী, এগুলো আত্মহত্যার ঝুঁকির সংকেত হতে পারে।
৩. মেজাজ ও অনুভূতির পরিবর্তন
বারবার দুঃখ, কান্না, রাগ বা আশাহীনতার কথা বলাও সতর্ক হওয়ার মতো বিষয়। বিশেষ করে যদি এগুলো সেই ব্যক্তির স্বাভাবিক চরিত্রের সঙ্গে মেলে না।
এমন দেখলে কীভাবে কথা বলবেন?
এই লক্ষণগুলো খেয়াল করেও অনেকে বিভ্রান্তিতে ভোগন যে, এই বিষয়টি নিয়ে কীভাবে কথা বলবেন। ভাবেন, সরাসরি প্রশ্ন করলে হয়তো সমস্যা আরও বাড়বে। কিন্তু গবেষণা বলছে, সরাসরি কথা বলুন। সংকোচ ছাড়াই খোলামেলা প্রশ্ন করলে মানুষ কথা বলার সুযোগ পায়।
প্রশ্ন করুন, ‘তুমি কেমন অনুভব করছো?’ বা ‘এমন কথা কেন বলছো?’ উত্তরে যা-ই আসুক, সেটিকে বিচার করবেন না। তাৎক্ষণিক সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করার চেয়ে তাকে নিজের মনের কথা খোলাখুলি বলার সুযোগ দিন।
পরিস্থিতি বেশি খারাপ মনে হলে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হতে পারে
>> যদি মনে হয় সে ঝুঁকিতে আছে, একা ছেড়ে দেবেন না।
>> পরিবার সহানুভূতিশীল হলে তাদের জানান।
>> স্থানীয় জরুরি হেল্পলাইন বা চিকিৎসকের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করুন।
>> প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি যাচাইয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইসাইড সিরিওসিটি রেটিং স্কেল। সহজ কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে এটি দিয়ে বোঝা যায় কেউ আত্মহত্যার কথা ভাবছে কি না, পরিকল্পনা করছে কি না, বা আগেও চেষ্টা করেছে কি না। বিশেষজ্ঞরা এ স্কেলের সাহায্যে দ্রুত ঝুঁকি নিরূপণ করতে পারেন।
শেষকথা
আত্মহত্যাপ্রবণ চিন্তাকে কখনোই ছোট করে দেখবেন না। আপনার সামান্য মনোযোগ, একটু খোঁজ নেওয়া হয়তো একজনের জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। মনে রাখবেন, সাহায্যের প্রথম ধাপ হলো পাশে দাঁড়ানো এবং শোনা।
সূত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মেন্টাল হেলথ, আমেরিকান ফাউন্ডেশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সুইসাইড সিরিওসিটি রেটিং স্কেল