যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় যারা অতীতে পড়েছেন, প্রায় সবাই হয়তো একবার হলেও শুনেছেন ‘এসব পড়ে কী হবে!’ বিশেষ করে মেয়েরা শুনেছেন ‘সাংবাদিকতা মেয়েদের পেশা না।’ এখন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়টি সামজিকবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থীদের অন্যতম পছন্দের একটি বিভাগ।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, মিডিয়া স্টাডিজ, কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস্সহ বিভিন্ন নামের বিভাগে যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন পড়ানো হয়। এটি মূলত একটি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সাবজেক্ট। এই বিষয়ে একই সঙ্গে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া যায়। আবার যোগাযোগে স্নাতক করে নিজের পছন্দের বিশেষায়িত কোনো শাখায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা সম্ভব।
সাংবাদিকতায় পড়ে যেকোনো বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট চায় এমন চাকরিগুলোতে যেমন আবেদন করা যায়, তেমনি এই সেক্টরের ডিগ্রিধারীদের জন্য বিশেষ কিছু পদও রয়েছে।
কেন আর কারা পড়বেন যোগাযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব বিষয়ে স্নাতক পড়ানো হয়, সবগুলোরই কোনো না কোনো কর্মক্ষেত্র আছে। কিন্তু চাকরির চিন্তা ছাড়া একজন শিক্ষার্থী জ্ঞানের কোন শাখার আগ্রহ নিয়ে যোগাযোগ বা মিডিয়া স্টাডিজ পড়তে চাইবেন? এই বিষয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন।
তিনি বলেন, ‘আমরা একটা সমাজে বাস করে ছোটবেলা থেকে পড়াশোনা করতে করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসে পৌঁছাই। এর মধ্যে অনেকের আগ্রহ থাকে নিজের দেশ ও সমাজটাকে বোঝার। তারা নিজের আশপাশের জগৎটাকে বুঝতে চায়, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সাথে আমরা কীভাবে জড়িত সেটা জানতে চায়। এই বিষয়গুলো যারা গভীরভাবে বুঝতে চায় তারা যদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টগুলোতে পড়ে, তাহলে তাদের সামনে অনেকগুলো দরজা খুলে যায়।’
সেলিম রেজা নিউটন আরো বলেন, ‘প্রতিদিনের জীবনে যে টেলিভিশন, ফিল্ম, বিজ্ঞাপন আমরা দেখি, যে সংবাদ আমরা পড়ি, এগুলো বোঝার আগ্রহ থাকে অনেকের। দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি, নিজের দেশের ইতিহাস – এগুলো জানার ও বোঝার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষুধা বা আগ্রহ যাদের আছে, এই ধরণের ছেলে-মেয়েদের জন্য জার্নালিজম এবং মিডিয়া স্টাডিজ অনেক ইন্টারেস্টিং হতে পারে।’
তিনি সামাজিকবিজ্ঞানকে একটি বহুমুখী শিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এই বিভাগে শিক্ষার্থীদের অনেকগুলো বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। পলিটিক্যাল সায়েন্স, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, দেশের সমাজকাঠামো, দেশের বিকাশের ইতিহাস – এর সবই আছে এই ডিসিপ্লিনে। একটা দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্তমানে কীভাবে কাজ করছে? রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্পর্ক কেমন? সেগুলোর সঙ্গে মিডিয়া, কালচার, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, ফটোগ্রাফির সম্পর্ক কী? আমাদের নিজেদের জীবনের প্রতিদিনের রুচি, স্টাইল, ফ্যাশনসহ নানান বিষয় কীভাবে সম্পর্কিত? আমরা যে ইন্টানেটের দুনিয়ায় বাস করি, এ রকম বিভিন্ন ডিজিটাল ইমেজ এবং কনটেন্টের সঙ্গে আমাদের জীবনের কী সম্পর্ক? এসব কনটেন্টের ভাষাতাত্ত্বিক ও সাংকেতিক ভিন্ন ভিন্ন অর্থ রয়েছে। প্রতীকী সম্পর্কগুলো কী রকম? এ রকম নানান ইন্টারেস্টিং বিষয়ের সাথে আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক পরিচিতির সুযোগ হয় এই বিভাগে পড়ার সময়। আবার কেউ কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে আগ্রহী হলে সেই বিষয়ে আরো এক্সপ্লোর করার সুযোগও আছে।’
কোথায় পড়তে পারি:
• ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬২ সালে প্রথম গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে এক বছর মেয়াদী পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স চালু হয়। তারপর ১৯৭৭-৭৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হয় অনার্স বা স্নাতক।
• এর বেশ কিছুদিন পর রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নব্বইয়ের দশকে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতাবিষয়ক বিভাগ চালু করে।
• জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ার সুযোগ পান, তাদের পছন্দের তালিকায় থাকে এই বিষয়।
• এ ছাড়াও ঢাকা বিভাগে বিষয়টি পড়ানো হয় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
• বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে।
• খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
• জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহে।
এ তো গেল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বর্তমানে এই ডিসিপ্লিনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আধুনিক প্রযুক্তির টেকনিক ও যন্ত্রের ব্যবহার এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগপোযোগী শিক্ষা দিচ্ছে তারা। সেসবের মধ্যে রয়েছে:
• ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
• নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি
• ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল অার্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)
• ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
• ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি
• সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি
• গ্রিন ইউনিভার্সিটি
• আমেরিকান ইন্টান্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
• স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
• ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ
• বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
• নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি
পেশাজীবনের বিভিন্ন পথ:
পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা কেমন? এ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর নিজস্ব প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘সব পেশার মতোই সাংবাদিকতা পেশায়ও প্রতিকূলতা রয়েছে, ধরণে ভিন্নতা রয়েছে। নতুন তথ্য বের করে মানুষকে জানাতে এখানে প্রতিদিনই যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। ভালো করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, তবে ভালোর কোনো সীমা নেই। প্রতিদিনই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে আরো ভালো কিছু করার সুযোগ আছে।’
তবে এ বিষয়ে পড়ালেখা করে যে সাংবাদিকই হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। ক্যারিয়ার গড়ার আরো বেশ কিছু ক্ষেত্র আছে। যেমন:
• কমিউনিকেশন অফিসার পদটি এখন প্রত্যেকটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকে। এই পদগুলোর জন্য সাধারণত যোগাযোগের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারেই আগ্রহী থাকে প্রতিষ্ঠানগুলো।
• পাবলিক রিলেশনস্ অফিসার বা পিআরও পদে অন্য ডিসিপ্লিনের গ্র্যাজুয়েটদের আবেদনের সুযোগ থাকলেও এই বিষয়ের যথাযথ জ্ঞান নিয়ে কর্মজীবনে গেলে দ্রুত উন্নতি করা যায় বলে ধরে নেওয়া হয়।
• কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট ও কনসালটেন্ট পদের জন্য যোগাযোগের শিক্ষার্থীরাই এগিয়ে থাকেন। এই পদগুলো এখন বেশিরভাগ সেবামূলক ও উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে বেশ গুরুত্ব পায়, এবং এসব পদের বেতনও বর্তমান বাজারে বেশ ভালো।
• একাডেমিক রেজাল্ট ভালো করে এখানে শিক্ষকতার সুযোগ তো আছেই।
• বিভিন্ন সামাজিক গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
• প্রেস সংক্রান্ত যেকোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষায়িত পদে রয়েছে চাকুরির সুযোগ।
• বর্তমান ডকুমেন্টেশনের যুগে বিশেষায়িত কোর্স বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি করে ফটোগ্রাফি ও ভিডিওগ্রাফির মতো ক্রিয়েটিভ কাজের সুযোগ রয়েছে।
• সিনেমাটোগ্রাফি/ফিল্মমেকিংয়ের ওপর পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া ও সেই ফিল্ডে ক্যারিয়ার তৈরির সুযোগ আছে।
• স্নাতকোত্তরের জন্য হিউম্যান রিসোর্স জাতীয় কোর্সকে মেজর করে এমবিএ করলে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভালো বেতনে চাকরি পাওয়া সম্ভব। একই সঙ্গে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞও হয়ে উঠতে পারেন।
• বিভিন্ন এনজিও এবং আইএনজিওতে যোগাযোগের গ্র্যাজুয়েটদের জন্য প্রজেক্ট অফিসার/কো-অর্ডিনেটরের মতো পোস্টগুলোও ভালো ক্যারিয়ার চয়েজ হতে পারে।
• আর উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন মাত্রার স্কলারশিপে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ তো আছেই।
• তবে এই পেশার চ্যালেঞ্জগুলো মুকাবিলায় সংশ্লিষ্ট খাতের নীতিনির্ধারকদের আরও মনোযোগী হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন রফিকুল ইসলাম। যেমন যোগ্যতার মূল্যায়ন, বেতন কাঠামো পুনর্গঠন, অপসাংবাদিকতা রোধে ব্যবস্থাগ্রহণ ইত্যাদি।
একাডেমিক পড়াশোনা ও বাস্তবিক পেশাজীবনের কাজের কী তফাৎ সাংবাদিকতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রের চর্চার পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাঠ্যক্রমে সংবাদ লেখা ও পরিবেশন যেভাবে পড়ানো হয়, কাজের ক্ষেত্রে অনেক সময়ই তা মেলে না। ফিল্ডে কাজ করতে করতে অনেক কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার নিত্যনতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়েও চলতে হয়, যা হয়তো ক্লাসে পড়ানো হয়নি। তবে সবগুলো বিষয় না মিললেও ভিত্তিটা কিন্তু একই।
- আরও পড়ুন:
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয় নির্ধারণ করবেন কীভাবে
কৃষিবিজ্ঞানে অনার্স, চাকরি কোথায়
কী আশায় পড়বো আইন?
বায়োটেক পোশাকশিল্পকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম
কেন পড়বেন জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি
এএমপি/আরএমডি/জেআইএম