৯ সেপ্টেম্বর হয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। এতে সহ-সভাপতি (ভিপি) হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম। নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনায় উঠে আসে আরও বেশ কয়েকজনের নাম। তবে সব ছাপিয়ে সাদিক কায়েমকে কেনো ভোট দিলেন শিক্ষার্থীরা সে নিয়ে সর্বত্র চলছে আলোচনা।
৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪৭১ জন। আর ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হয়েছে ১৩টি পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৩৫ জন। ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ছিল ৩৯ হাজার ৮৭৪। এর মধ্যে পাঁচটি ছাত্রী হলে ১৮ হাজার ৯৫৯ আর ১৩টি ছাত্র হলে ভোটার ২০ হাজার ৯১৫ জন ভোটার ছিল। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন থেকে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন। ছাত্রশিবিরের সাদিক কায়েম ১৪ হাজার ৪২ ভোট পেয়ে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ডাকসুর ১২টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ৯টিতে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা জয়ী হন। এ ছাড়া ডাকসুর ১৩টি সদস্য পদের মধ্যে শিবিরের প্রার্থীরা ১১টিতেই জয়ী হয়েছেন। সবমিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এখন ছাত্রশিবিরের জয়জয়কার।
ফলাফল পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের বিপুল ভোটে জয়ী সাদিক কায়েম বলেন, যে মতের হোক না কেন সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করবেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা আমাদের প্রত্যাশা। আমরা ক্যাম্পাসকে স্বপ্নের ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তুলবো। যারা একসঙ্গে নির্বাচন করেছেন তারা প্রত্যেকে উপদেষ্টা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন,, তারা আমাদের পরামর্শ দেবেন। ৫ আগস্টের কথা স্মরণ করে সাদিক কায়েম বলেন, জুলাই বিপ্লব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগামী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখবেন।
কে এই সাদিক কায়েম
আওয়ামী লীগ সরকার পতনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন মো. আবু সাদিক কায়েম। সমন্বয়কদের তালিকায় তার নাম না থাকলেও তিনি সরব ছিলেন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের পাশেই। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন-পরবর্তী সময়ে সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠতা। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে এক বৈঠক করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান। সেখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধি হিসেবে সাদিক কায়েমকে দেখা যায়। তিনি সেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে সংস্কারের দাবি জানান। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সাদিক কায়েম নিজেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বলে পরিচয় দেন। পরে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্টও দেন তিনি। তার এই ঘোষণার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক যুগেরও বেশি সময় পর সরব উপস্থিতি জানান দেয় ইসলামী ছাত্রশিবির।
- আরও পড়ুন:
- ডাকসুর ভিপি হলেন সাদিক কায়েম
- যে মতেরই হোক না, সবাই একসঙ্গে কাজ করবো: সাদিক কায়েম
- সাদিক কায়েমকে নিয়ে এত আলোচনা কেন?
সাদিক কায়েম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। তার বাড়ি খাগড়াছড়ি শহরের বাজার এলাকায়। তার বাবা জেলা শহরের একজন কাপড় ব্যবসায়ী। ছোট ভাইও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সাদিক খাগড়াছড়ি বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া আদর্শ মাদরাসা থেকে দাখিল এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ থেকে আলিম পাস করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। মেধাবী এই তরুণ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ফলাফলে নিজ বিভাগে তৃতীয় হয়েছিলেন। স্নাতকে তার সিজিপিএ ছিল ৩ দশমিক ৭৮। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে এখন তিনি এমফিল করছেন।
সাদিক কায়েম পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি, হিল সোসাইটি সাবেক প্রতিষ্ঠাতা, সেভ ইয়ুথ-স্টুডেন্টস অ্যাগেইন্সট ভায়োলেন্সের সাবেক ফ্যাসিলিয়েটর, সূর্যসেন হল অ্যাসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল সায়েন্সের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বাংলাদেশ ইয়ুথ ইনিশিয়াটিভ-বিওয়াইআইয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর এখন ডাকসুর নির্বাচনে জয়ী হয়ে দায়িত্ব পেলেন পুরো ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে।
জুলাই আন্দোলনের সময় সাদিক কায়েম সালমান নামেও পরিচিত ছিলেন
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সভাপতি সাদিক কায়েমকে সালমান নামে চিনতেন প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান সামি। সাদিককে নিয়ে জুলকারনাইন সামি তার ফেসবুকে লেখেন, শাদিক কাঁইয়ূম, এবং তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সভাপতি। অবশ্যই অবাক হয়েছি, বেশ অবাক হয়েছি। কিন্তু প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ না পেয়েও শিবির যে সালমানের (আমার কাছে সে সালমানই থাকবে), মতো একটা নেতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে তার জন্যে সাধুবাদ জানাই। ছাত্র রাজনীতি সুষ্ঠ ধারার গণতন্ত্রের জন্যে অত্যাবশ্যক, এবং তার সদ্ব্যবহার করে যে কোন রাজনৈতিক দলই যদি সালমান কিম্বা কাদেরের মতো তরুণ-তরুণীদের এত ম্যাচিউর্ড নেতা/নেত্রী হিসেবে তৈরি করতে পারে, তাহলে মন্দ কি?’
- আরও পড়ুন:
- ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয়
- স্বপ্নের ক্যাম্পাস বিনির্মাণের আগে থামবো না: সাদিক কায়েম
- সবাইকে নিয়ে কাজ করতে বিজয়ীদের প্রতি শিশির মনিরের আহ্বান
সেই সালমান অর্থাৎ সাদিক কায়েমের ঢাবির ক্যাম্পাসে জয়ের বিষয়ে শিবিরের নেতারা বলছেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ রাখা, সংকটে পাশে থেকে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন কাজে গত এক বছর যুক্ত ছিলেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা, বিশেষ করে সাদিক। কিন্তু এ নিয়ে তারা প্রচার চালাতেন না, এই বিষয়টি সাধারণ শিক্ষার্থীদের নজর কেড়েছে। তাছাড়া, নির্বাচনে বিভিন্ন প্যানেলের ভোট কয়েক ভাগে ভাগ হলেও শিবিরের ভোট সেভাবে ভাগ হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ডাকসুর সাবেক ছাত্রনেতারা মনে করেন, জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনা থেকে মাঠ পর্যায়ের সব নেতৃত্বেই শিবির ছিল, এমন ন্যারেটিভও ডাকসু নির্বাচনে তাদের জয়লাভের অন্যতম কারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের হলগুলোর প্রায় বেশিরভাগ ভোটই পড়েছে ছাত্রশিবিরের ঝুলিতে। ঢাবির অনেক ছাত্রী বলেছেন, তাদের আচার-আচরণ, ভালো ব্যবহার, সহযোগিতার মনোভাব, নারী শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাসে হয়রানি না করা এসব বিষয়ও বিবেচনায় ছিল ভোটারদের।
ডাকসুর ভিপি পদে জয়লাভ করা সাদিক কায়েমের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খানের ভোটের ব্যবধান নয় হাজারেরও বেশি। সাদিকের এই বিশাল ব্যবধানে জয়ী হওয়ার পেছনে আরও একটি কারণের কথা বলেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তারা বলছেন, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের হারের পেছনে কাজ করেছে গণ অভ্যুত্থান পরবর্তী তাদের অনেকের বিরুদ্ধেই চাঁদাবাজি, দুর্নীতি বা বিভিন্ন ধরনের ওঠা অভিযোগ। যেখানে উল্টো দিকে ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক দক্ষতা, সহযোগিতার মনোভাব, যোগাযোগের কৌশল তরুণ প্রজন্মের ভোটারদের বিবেচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজনীতি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিল। অনেকটা নিরবে থেকেই সংগঠনের কার্যক্রম চালান সাদিক কায়েমরা। ৫ আগস্টের পর রাজনীতির মাঠে কৌশল বদলে অনেকটা প্রকাশ্যে আসা শুরু করে ইসলামী ছাত্রশিবির। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবিরের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা ছিল সর্বত্র। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ শুরু থেকে দাবি করে আসছিল, এ আন্দোলনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে জামায়াত-শিবির। যদিও ছাত্রসংগঠনটির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের এ দাবির বিরোধিতা বা সমর্থন করে কিছু বলা হয়নি।
এসএনআর/এএসএম