প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি প্রাণীর আছে নিজস্ব ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সেই তালিকায় শকুন অবিচ্ছেদ্য নাম। যদিও অনেকেই শকুনকে অপছন্দের চোখে দেখেন। কিন্তু বাস্তবে পাখিটি পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখার কাজে অনন্য অবদান রাখে। প্রকৃতির সমস্ত বাসি, পচা, দুর্গন্ধযুক্ত মৃত প্রাণীর দেহ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার করে। রোগমুক্ত রাখে মানুষ এবং অন্য প্রাণীকে। এ কারণেই শকুনকে ‘প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী’ বলা হয়। তবে বর্তমানে শকুনের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বে মোট ১৮টি প্রজাতির শকুন আছে, যার মধ্যে বাংলাদেশে দেখা যায় ছয়টি প্রজাতি। যেখানে ৪ প্রজাতি স্থায়ী আর ২ প্রজাতি পরিযায়ী। এর মধ্যে ‘বাংলা শকুন’কেই অন্যতম মনে করেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নাম Gyps bengalensis। লম্বায় ৯০ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ৪ দশমিক ৩ কেজি। পালক ময়লা কালচে বাদামি। সেপ্টেম্বর-মার্চ তাদের প্রজননকাল। স্ত্রী শকুন সাদা রঙের একটি মাত্র ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ৪০-৪৫ দিনে। শকুনের গলা, ঘাড় ও মাথায় কোনো পালক থাকে না। প্রশস্ত ডানায় ভর করে আকাশে ওড়ে। লোকচক্ষুর আড়ালে বট গাছসহ বিশালাকার গাছে সাধারণত বাসা বাঁধে।
শকুনের দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। তারা আকাশে ওড়ার সময় নিচের পরিবেশের প্রতিটি নড়াচড়া পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় এবং মৃত প্রাণীর অবস্থান শনাক্ত করে দ্রুত নেমে আসে। মৃত ও পচনশীল প্রাণীদেহ খেয়ে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখে। শুধু তা-ই নয়, অন্তত ৪০ ধরনের সংক্রামক রোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করে। যেমন- অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা ইত্যাদি। ফলে মানুষ ও অন্য পশু-পাখি সুস্থ থাকে।
একসময়ে দেশে প্রায় সর্বত্রই দেখা মিলতো শকুনের। তবে নানা কারণে এ পাখি আজ বিলুপ্তির পথে। বর্তমানে শুধু মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বনে এবং সুন্দরবন এলাকায় কিছু সংখ্যক শকুনের দেখা মেলে। ২০১৪ সালে দেশের দুটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা ঘোষণা করে সরকার। প্রথমটি সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের কিছু অংশ এবং দ্বিতীয়টি খুলনা, বরিশাল ও ঢাকা বিভাগের কিছু অংশ।
কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে শকুন
শকুনের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, গবাদিপশুর জন্য ব্যবহৃত ডাইক্লোফেনাক ও কেটোপ্রোফেনের ব্যবহার। এ দুই ওষুধের প্রভাব মৃত পশুর দেহেও থাকে। ফলে মৃত পশুর মাংস খেয়ে মারা যাচ্ছে পরিবেশ উপকারী পাখিটি। ২০১০ সালে দেশে ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ করা হয়। তবে এখনো ওষুধটি বিক্রি হয় বলে অভিযোগ আছে। ডাইক্লোফেনাকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শকুন বিলুপ্তির মুখে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ওষুধটি ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে অনেক আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া কৃষিতে অতিমাত্রায় কীটনাশক, ইঁদুর ও পোকামাকড় জাতীয় জীব-জন্তু মারার জন্য বিষমিশ্রিত খাদ্য প্রয়োগ, বায়ুশক্তি উৎপাদনের যন্ত্রের পাখার সঙ্গে সংঘর্ষে এবং উঁচুগাছ কেটে ফেলায় প্রজননের স্থান মারাত্মক হ্রাস পাওয়ায় শকুন হারিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ শকুন বছরে একবার একটি ডিম পাড়ে এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। অনেক সময় তা-ও ফোটে না। ফলে এদের প্রজননের হার খুব ধীর। বিষয়টি শকুনের বংশ বিস্তারের জন্যও হুমকি।
শকুনের বিলুপ্তি এবং রক্ষার জন্য করণীয় নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি, অ্যানিম্যাল ও বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সেস অনুষদের অধ্যাপক ড. অনিমেষ চন্দ্র রায়। তিনি বলেন, ‘শকুন বিলুপ্তির অন্যতম প্রধান কারণ হলো ভেটেরিনারি ওষুধ ডাইক্লোফেনাক। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত এ ওষুধ পশুর শরীরে থেকে যায়। মৃত পশুর মাংস খাওয়ার সময় শকুনের দেহে প্রবেশ করে। এতে শকুনের কিডনি বিকল হয়ে যায় এবং দ্রুত মৃত্যু ঘটে। এ ছাড়া বনভূমি উজাড়, গ্রামাঞ্চলে বড় বড় গাছ কাটা, খাদ্যের অভাব, বৈদ্যুতিক তারে জড়িয়ে যাওয়া এবং পাখিটি দেখতে কালো ও ভয়ংকর হওয়ার কারণে অনেকেই মেরেও ফেলেন।’
ড. অনিমেষ চন্দ্র রায় বলেন, ‘উন্নত চিকিৎসার কারণে আগের মতো গবাদিপশু মারা যায় না। আর মারা গেলেও খোলা মাঠে ফেলে না রেখে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। এতে শকুনের জন্য খাদ্যসংকট তৈরি হয়। এসব কারণে শকুন প্রজনন করতে পারছে না। ফলে দিন দিন বিলুপ্তির পথে এগোচ্ছে উপকারী পাখিটি।’
শকুনের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘শকুন শুধু একটি পাখি নয়, এটি পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এদের উপকার আমরা তখনই বুঝতে পারি; যখন এদের অনুপস্থিতিতে বায়ুদূষণের মাধ্যমে নানাবিধ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তাই এখনই সময় সচেতন হওয়ার। শকুনকে রক্ষা করতে হলে তাদের জন্য খাদ্য, নিরাপদ আবাসস্থল ও প্রজননের জন্য সঠিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গবাদিপশুর চিকিৎসায় ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহারে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’
এ ছাড়া এ অধ্যাপক পরামর্শ দেন, ‘শকুনের গুরুত্ব সম্পর্কে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে ক্যাম্পেইন, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করা উচিত। যথাযথ প্রচার-প্রচারণা না চালালে পরিবেশ উপকারী পাখিটির অস্তিত্ব ভবিষ্যতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এতে আমাদের পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য আরও হুমকির মুখে পড়বে।’
এসইউ/এএসএম