মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে সহজ, নিরাপদ ও উন্নত করার পেছনে প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। খাবার প্রক্রিয়াকরণ থেকে শুরু করে জ্বালানি উৎপাদন, ওষুধ প্রস্তুত, পানি বিশুদ্ধকরণ, কাগজ, প্লাস্টিক কিংবা প্রসাধনী—সবখানেই এই টেকনোলজির ছোঁয়া আছে। তাই দিন দিন বিশ্বজুড়ে বাড়ছে এ কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে—কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং আসলে কী? এ টেকনোলজির কাজ কী? এ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের পর শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার বা কর্মসংস্থান কেমন হতে পারে? এ ছাড়া আরও প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। সেসব নিয়েই আজকের আয়োজন—
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কী?
আধুনিক বিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমুখী প্রকৌশল শাখা হলো কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। শাখাটি মূলত কাঁচামালকে দরকারি ও ব্যবহারযোগ্য পণ্যে রূপান্তরের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পদ্ধতি নিয়ে কাজ করে। এখানে রসায়ন, গণিত, পদার্থবিদ্যা ও জীববিজ্ঞানের জ্ঞান একত্রে ব্যবহার করে কাজ করা হয়। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা শিল্প-কারখানায় উপাদান বিশ্লেষণ, পেট্রোলিয়াম পরিশোধন, শক্তির অপচয় রোধ, কম খরচে উন্নতমানের অধিক উৎপাদন নিশ্চিতকরণ এবং রাসায়নিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার নকশা ও তত্ত্বাবধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
তারা ল্যাবরেটরির ছোট স্কেলের পরীক্ষাকে বড় পরিসরের শিল্প পর্যায়ে রূপান্তর করেন, যা বাস্তব উৎপাদনে অসাধারণ প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যগুলো যেন পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ হয়; সেদিকেও কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা খেয়াল রাখেন। বড় বড় মিল-কারখানা, রিফাইনারি, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফুড প্রসেসিং ইউনিট—সবখানেই কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের অবদান অপরিহার্য। আধুনিক সভ্যতার প্রতিটি ধাপে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়
একজন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, প্লান্টগুলোর যাবতীয় ডিজাইন, নতুন পণ্য উৎপাদন এবং তার কার্যক্রমের পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা করে থাকেন।
যেসব বিষয়ে পড়ানো হয়
১. রাসায়নিক প্রক্রিয়া গণনা
২. তরল বলবিদ্যা
৩. তাপ স্থানান্তর
৪. ভর স্থানান্তর
৫. রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া প্রকৌশল
৬. উষ্ণতাত্ত্বিক
৭. যান্ত্রিক প্রক্রিয়া
৮. প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ ও যন্ত্রপাতি
৯. পরিবেশ প্রকৌশল
১০. প্রক্রিয়া যন্ত্রপাতি ডিজাইন
১১. জৈবপ্রযুক্তি ও জৈব-প্রক্রিয়া
১২. শক্তি প্রকৌশল।
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভবিষ্যৎ
বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ এবং জ্বালানির ঘাটতি—এগুলো এখন বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব সংকট সমাধানে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই প্রযুক্তির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই পরিবর্তনশীল বাস্তবতায় কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। কারণ তারা এসব প্রযুক্তির উদ্ভাবন, উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের মূল চালিকাশক্তি।
বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, যেমন- সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ও বায়োফুয়েল বাড়ছে। এসব শক্তি উৎপাদন, রূপান্তর এবং সংরক্ষণের জন্য যে জটিল প্রযুক্তি দরকার, তা উন্নয়নে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের অবদান অনস্বীকার্য। শুধু শক্তি নয়, ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা খাতেও তাদের চাহিদা আছে।
এ ছাড়া আধুনিক শিল্পকারখানায় পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, শক্তি-সাশ্রয়ী উৎপাদন প্রক্রিয়া ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবহারের ফলে এই টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের গুরুত্ব আরও বাড়ছে। একই সঙ্গে তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অটোমেশন, রোবটিক্স এবং ন্যানোটেকনোলজির মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মিল রেখে কাজ করতে পারায় তারা বহুমুখী ক্ষেত্রেও যুক্ত হতে পারছেন। যতদিন পৃথিবীতে শিল্পকারখানা থাকবে; ততদিন এই টেকনোলজির চাহিদা থাকবে।
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের কর্মসংস্থান
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত বিস্তৃত। দেশে তেল ও গ্যাস, পেট্রোকেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, খাদ্য ও পানীয়, সার ও অন্যান্য রাসায়নিক শিল্প, পানি পরিশোধন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে সরকারি ও বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে এই টেকনোলজির ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। বাংলাদেশের তুলনায় বিদেশে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারদের চাহিদা আরও বেশি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এই খাতে দক্ষদের চাহিদা আছে। এ ছাড়া পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই শিল্প উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত খাতগুলোতেও তাদের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।
সরকারি চাকরি
১. বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন
২. পেট্রোবাংলা ও এর অধীনস্থ সংস্থাগুলো
৩. বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন
৪. বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন
৫. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়
৬. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড
৭. স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর
৮. বাংলাদেশ ব্যাংক
৯. বিভিন্ন কমিশন ও সংস্থার বিশেষ প্রকল্প।
বেসরকারি চাকরি
১. রাসায়নিক ও পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প
২. ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি
৩. খাদ্য ও পানীয় শিল্প
৪. তেল ও গ্যাস খাত
৫. পরিবেশ ও পানি ব্যবস্থাপনা সংস্থা
৬. গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা।
অন্য ক্যারিয়ার
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কারিগরি ট্রেনিং সেন্টারেও চাকরি করতে পারবেন। এ পেশায় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগও আছে। কেউ চাইলে কেমিক্যাল, প্রসাধনী, ক্লিনার, ফার্মাসিউটিক্যাল বা ফুড প্রসেসিংয়ের সেন্টার গড়ে তুলতে পারেন। গবেষণার মাধ্যমেও নিজেকে প্রমাণ করা যাবে। ভালো দক্ষতা, নতুন প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা থাকলে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে দেশ কিংবা বিদেশে সহজেই উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সম্ভব।
কারা পড়বেন
কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তাদের জন্য; যারা রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ে দক্ষ এবং নতুন জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী। যারা সৃজনশীল চিন্তা করে গবেষণামূলক কাজ পছন্দ করে এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে চায় তাদের জন্য এই টেকনোলজি উপযোগী। তবে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে হলে অবশ্যই পরিশ্রম, ধৈর্য ও দলবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে।
কোথায় পড়বেন?
যদি কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার বা ডিপ্লোমা কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে চান, তাহলে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪ বছর মেয়াদি বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। ডিপ্লোমা ইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য সরকারি ও বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট আছে। ডিপ্লোমা শেষে সরকারিভাবে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (ডুয়েট) বিএসসি করার সুযোগ আছে। এ ছাড়া দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বিএসসি করা যাবে।
এসইউ/জিকেএস