মোহাম্মাদ সোহেল রানা
গ্রামীণ আঁধার রাতে জোনাকির আলো ছিল আমাদের শৈশবের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গাছপালা ও ঝোপঝাড়ের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ জ্বলে উঠত ঝিকিমিকি আলো, চারপাশের প্রকৃতি যেন সাজত এক ভিন্ন রূপে। সন্ধ্যা নামলেই শুরু হতো জোনাকির পেছনে ছুটে চলা-হাতের মুঠোয় ধরে রাখা, আবার উড়িয়ে দেওয়া। কখনো কৌতূহলবশত উল্টে-পাল্টে দেখা হতো কীভাবে এত সুন্দর আলো জ্বলে জোনাকির শরীরে।
জোনাকির আলো নিয়ে শৈশবের খাতায় জমে আছে অসংখ্য স্মৃতি। এই ঝিকিমিকি আলো শিশুদের মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিত, মনে হতো-এ যেন কোনো জাদুর খেলা। তবে জোনাকির সেই আলো দিন দিন যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। আগের মতো আর চোখে পড়ে না। তখনি মনে প্রশ্ন জাগে-কেন কমে যাচ্ছে জোনাকি, কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে শৈশবের সেই মায়াবী আলো?
জোনাকিসহ কিছু পোকামাকড় আছে, যারা আলোর জন্য বিখ্যাত। এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্যকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স বা জৈব আলোকধারা। বিশ্বজুড়ে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি প্রজাতির জোনাকি রয়েছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে-সব জোনাকিই আলো দেয় না। প্রাপ্তবয়স্ক জোনাকি ছাড়াও জোনাকির লার্ভা এমনকি ডিম থেকেও আলো উৎপন্ন হতে দেখা যায়। এটি তাদের একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রক্রিয়া।
জোনাকির আলো পৃথিবীর অন্যতম কার্যকর আলো। কারণ এ আলোর পুরোটাই আলোকশক্তি। এজন্য বিজ্ঞানীরা জোনাকির আলোকে কোল্ড লাইট বা শীতল আলো বলে অভিহিত করেন। জোনাকির লার্ভা সাধারণত ছোট শামুক ও কীটপতঙ্গ খেয়ে থাকে।
জোনাকির জীবনচক্রেও আলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রজননের সময় তারা আলো ব্যবহার করে সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কিছু কিছু প্রজাতিতে শুধু পুরুষ বা শুধু স্ত্রী জোনাকি আলো দেয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উভয়েরই এই ক্ষমতা থাকে। আলো শুধু প্রজননের জন্য নয়-যোগাযোগ এবং শিকারীকে সতর্ক করতেও ব্যবহৃত হয়।
রাতের নিস্তব্ধতা, কুয়াশায় ঢাকা আকাশ, দূরের ঝোপঝাড় বা বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, আর ঘাস-পাতার ফাঁকে জ্বলে ওঠা জোনাকির আলো একসময় গ্রামীণ জীবনের চিরচেনা দৃশ্য ছিল। বিশেষ করে বর্ষা ও শরৎকালের রাতে জোনাকির আলো বেশি দেখা যেত। শিশুদের খেলার সঙ্গী হয়ে উঠত এই পোকা। দল বেঁধে ছুটতে ছুটতে তারা জোনাকি ধরার মজায় মেতে উঠত। তবে শুধু শিশুরাই নয় প্রকৃতিপ্রেমী সব বয়সী মানুষের মন ছুঁয়ে যেত সেই অসাধারণ আলো।
কিন্তু আজ? রাত আসে ঠিকই, অন্ধকারও নামে আগের মতো, তবে সেই চেনা ঝিকিমিকি আলো আর তেমন চোখে পড়ে না। যদিও কোথাও কোথাও দেখা যায়, তবে তা খুবই সীমিত। জোনাকির আলো যেন ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাতের প্রকৃতি থেকে- নিভে যাচ্ছে একটুকরো শৈশব, নিভে যাচ্ছে প্রকৃতির এক অনন্য সৌন্দর্য।
কেন জোনাকির আলো হারিয়ে যাচ্ছে এ নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ।
তিনি বলেন, জোনাকি পোকা দিনদিন কমে আসার পেছনে প্রধানত দুইটি কারণ দায়ী। প্রথমত মাত্রা অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা। আমরা জোনাকি পোকা সাধারণত রাতে দেখতে পাই কিন্তু এরা দিনের বেলাতেও থাকে। রাতের অন্ধকারে তাদের আলো আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয়, তাই আমরা ভাবি তারা শুধু রাতেই থাকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, তারা দিনেও একইভাবে আমাদের আশপাশে থাকে। ফসলের ক্ষেতে অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য যখন আমরা মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করি, তখন সেই রাসায়নিক পদার্থ জোনাকি পোকার ওপর প্রভাব ফেলে। ফলে এদের জীবনচক্র থেমে যায় বা এরা মারা যায়।
অধ্যাপক ড.মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ আরও বলেন, দ্বিতীয়ত জোনাকির বসবাসের জন্য যে বাসস্থান দরকার বা যেই পরিবেশ দরকার তা আমরা নানা কারণে ধ্বংস করছি। যেমন বন জঙ্গল উজার করে বাড়িঘর নির্মাণ, পরিবেশ ধ্বংস করে বসতি স্থাপন করা। আমাদের ক্যাম্পাসেও বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্প বা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আমরা ঝোপঝাড় ধ্বংস করি। ফলে তাদের বাসস্থান ধ্বংস হয়ে যায় এবং এটা তাদের সংখ্যা দিন দিন কমে আসার অন্যতম প্রধান কারণ।
জোনাকি পোকা হারিয়ে যাওয়ার আরও কিছু কারণ-
১. আলোক দূষণ
শহরের তো বটেই, বর্তমানে গ্রামেও রাত আর আগের মতো ঘন অন্ধকারে ঢাকা থাকে না। বৈদ্যুতিক আলো, স্ট্রিটলাইট, বিলবোর্ড কিংবা ঘরের বাহারি আলোকসজ্জা- সবকিছু মিলিয়ে রাতের আকাশও যেন হারিয়ে ফেলেছে তার নিজস্ব রূপ। অথচ জোনাকিরা প্রাকৃতিক অন্ধকারে আলো দিয়ে সঙ্গী খুঁজে নেয়। কিন্তু কৃত্রিম আলোয় তারা বিভ্রান্ত হয়, ফলে তারা স্বাভাবিক প্রজনন করতে পারে না। ধীরে ধীরে তাদের সংখ্যা কমে আসছে।
২. কীটনাশকের অতিব্যবহার
আধুনিক কৃষিতে ফসল রক্ষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক শুধু ক্ষতিকর পোকা নয়, উপকারী অনেক প্রজাতিরও মৃত্যু ডেকে আনছে। জোনাকির লার্ভা সাধারণত মাটির নিচে বাস করে এবং ছোট ছোট পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু যখন সেই মাটি বিষাক্ত হয়ে পড়ে, তখন তাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। বিষাক্ত জমিতে জোনাকির ভবিষ্যৎও আজ অনিশ্চিত।
৩. বন ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস
জোনাকি সাধারণত গাছপালা ঘেরা, আর্দ্র ও ছায়াঘেরা পরিবেশে বাস করতে পছন্দ করে। কিন্তু ক্রমাগত নগরায়ন, বন উজাড়, জলাভূমি ভরাট ও প্রকৃতির নিঃসঙ্গতা-সব মিলে তাদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু তারা নির্দিষ্ট পরিবেশে টিকে থাকতে অভ্যস্ত, তাই এই পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে তারাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তন
জলবায়ু পরিবর্তন শুধু মানুষের জন্যই নয়, ছোট ছোট জীবজগতের জন্যও এক বিশাল হুমকি। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মৌসুমি পরিবর্তনের ব্যতিক্রমতা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত-এসব কারণে অনেক অঞ্চলে জোনাকির অনুকূল পরিবেশ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এক বৈশ্বিক সমস্যা, যার প্রভাব পড়ছে সবখানে, এমনকি এই ক্ষুদ্র কিন্তু অপার বিস্ময় জোনাকির জীবনেও।
জোনাকি শুধু একটি ক্ষুদ্র পোকা নয়, এটি আমাদের প্রকৃতির এক অপূর্ব নিসর্গিক অলংকার। তার আলো রাতের গভীর অন্ধকারে ছড়িয়ে দেয় এক শান্তিময় সৌন্দর্য, যা আমাদের মনে জাগায় মুগ্ধতা ও প্রশান্তি। জোনাকির হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রাণীর বিলুপ্তি নয়, বরং প্রকৃতির ভারসাম্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশের বিলুপ্তি। তাই পরিবেশ সংরক্ষণ, কীটনাশকের সচেতন ব্যবহার, বনাঞ্চল ও জলাভূমির সুরক্ষা এবং প্রাণিকুলের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাব গড়ে তোলার মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে আনতে পারি জোনাকির সেই হারিয়ে যাওয়া আলো এবং প্রকৃতিকে দিতে পারি তার হারানো সৌন্দর্যের এক ঝলক।
আরও পড়ুন
কেএসকে/এমএস