দাম্পত্য কলহ ও আর্থিক সংকটের কারণে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান শাহিনুর বেগম (৫২)। তার স্বামীর বাড়ি কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার বড় সাপমারা (মুগারচর) গ্রামে।
এক যুগ আগে স্বামী মো. হাফিজ ভূঁইয়া দ্বিতীয় বিয়ে করার পর ভরণপোষণ বন্ধ করে দেন। তখন অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করে নিজের পাঁচ সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে দিন কাটাতেন শাহিনুর। মূলত খাওয়া-পড়ার অভাবে দিশেহারা হয়ে সন্তানদের নিয়ে গ্রাম ত্যাগে বাধ্য হন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শনির আখড়ার বিপরীত পাশে গোবিন্দপুর জাপানি বাড়ির একটি বস্তিতে ওঠেন।
বড় মেয়ে হাফেজা (৩০) জানান, সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে নারী হয়েও মাছ বেচতেন তার মা। যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে মাছ কিনে তা কাজলা বাজারে খুচরা বিক্রি করতেন। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শাহিনুর বেগম।
হাফেজা জানান, প্রতিদিনের মতো গত বছরের ২২ জুলাই জীবিকার তাগিদে সকাল ৮টায় পাইকারিতে মাছ কেনার জন্য যাত্রাবাড়ী যাচ্ছিলেন। তখন কাজলা পৌঁছাতেই পথচারীদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে পুলিশ। এর মধ্যে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয়জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এদের মধ্যে শাহিনুরও ছিলেন। ঘটনাস্থলে কাতরাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু কেউ এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। পুলিশ চলে গেলে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ভ্যান গাড়িতে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। এ সময় তার রক্তে পুরো রাস্তাজুড়ে ছোপ ছোপ দাগ পড়ে যায়। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পরও সহজে চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না। প্রায় দুই ঘণ্টা পর শাহিনুর বেগমের চিকিৎসা শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত বছরের ৯ আগস্ট তিনি মারা যান।
সম্প্রতি ঢাকার শনির আখড়ার গোবিন্দপুরে নারী শহীদ শাহিনুরের বাসায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট দুটি রুম নিয়ে কোনোমতে গাদাগাদি করে সেখানে বসবাস করছেন তার সন্তানরা। পরিবেশ একেবারেই ঘিঞ্জি। সন্তানরা বড় হওয়া পর্যন্ত নিজের উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতেন। অবশ্য সন্তানরা বড় হলে অর্থ উপার্জনে তারাও মায়ের সঙ্গে যুক্ত হন।
এরই মধ্যে তিন মেয়ে হাফেজা (৩০), মেজ মেয়ে জেসমিন (২৮) ও তাছলিমাকে (২৫) বিয়ে দিয়েছেন। তবে মেয়েদের স্বামীরাও আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নন। বড় মেয়ে হাফেজা তার সন্তানদের নিয়ে মা শাহিনুর বেগমের বাসায় থাকেন। সঙ্গে রয়েছেন দুই ভাই শরীফুল ইসলাম (২৩) ও রবিউল (১৮)। মায়ের সঙ্গে ফুটপাতে ছিন্নমূল ব্যবসা করতেন বড় মেয়ে হাফেজা (৩০)। আর রায়েরবাগ বাস স্ট্যান্ডে পিঠা বিক্রি করেন মেজ মেয়ে জেসমিন (২৮) ও সবার ছোট ভাই রবিউল (১৮)। অপরদিকে শাহিনুর বেগমের বড় ছেলে শরীফুল ইসলাম (২৩) জীবিকার তাগিদে সম্প্রতি সৌদি আরবে প্রবাসী হয়েছেন।
শাহিনুরের বড় মেয়ে হাফেজা বেগম বলেন, আমার বাবার সঙ্গে মায়ের বিচ্ছেদ না হলেও বাবা দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গ্রামে থাকছেন।
গত ১২ বছর ধরে বাবার কাছ থেকে কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়নি। অবশ্য তিনিও আর্থিকভাবে তেমন শক্তিশালী নন। তাই মা ঢাকায় এসে মাছ বিক্রি শুরু করেন। প্রথমে তার উপার্জিত টাকা দিয়েই সংসার চলত। পরবর্তী সময়ে তিনিসহ অন্যান্য ভাই-বোনেরাও মায়ের সঙ্গে কাজ করতেন। তার মৃত্যুর পর তারা নিজেরা এখন অর্থ সংকটে ভুগছেন।
হাফেজা আরও বলেন, মা থাকতেই আমার ভাই শরীফুল ইসলামকে সৌদি আরবে পাঠানোর চেষ্টা করছিলেন। এক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রগতিও হয়েছিল। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব গেলেও তা দেখে পারেননি মা শহিনুর বেগম। তিনি বলেন, আমার মা এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন ভাবতেও পারিনি। শুনেছি আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় স্থানীয় বিএনপির একজন নেতার পক্ষ থেকে যাত্রাবাড়ী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। কিন্তু মামলার আসামি কারা বিস্তারিত আমাদের জানা নেই।
তিনি জানান, তার মায়ের মৃত্যুর বিষয়ে মেঘনা উপজেলা বিএনপি ও জামায়াতসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা খোঁজখবর নিয়েছেন। জানাজায় এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন। অনুদান হিসেবে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২ লাখ ও জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন।
শাহিনুরের মেজ মেয়ে জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, যতই অনুদান দেওয়া হোক না কেন আমার মাকে কি আর ফিরে পাব? কোনো অনুদানই আমার মায়ের সমান নয়। তিনি নিজে অনেক কষ্ট করে আমাদেরকে লালনপালন করেছেন। তিনি তার মায়ের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
মেঘনা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রমিজ লন্ডনি বলেন, তরা শাহিনুর বেগমের পরিবারের বিষয়ে সব সময়ই খোঁজখবর রাখছেন।
ভবিষ্যতেও সব সময় পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তিনি।
মেঘনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হ্যাপী দাস জানান, শহীদ শাহিনুরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তার সন্তানদের হাতে দুই লাখ টাকার চেক হস্তান্তর করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে আরও কোনো নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।